২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

দুর্গাপূজার কাহিনি

বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম দুর্গাপূজা। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে দশম দিন পর্যন্ত পাঁচ দিন দুর্গোৎসব হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। ১৪ অক্টোবর মহালয়ার মাধ্যমে দুর্গা দেবীকে মর্ত্যলোকে আহ্বান জানানো হয়েছে। ২০ অক্টোবর ষষ্ঠী পূজায় দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মাধ্যমে শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা পেয়েছে। এরপর ২১ অক্টোবর সেপ্টেম্বর মহাসপ্তমী, ২২ অক্টোবর মহাষ্টমী, ২৩ অক্টোবর এবং ২৪ অক্টোবর বিজয়া দশমীর দিনে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হবে।

দেবীর দুর্গার শুরু কোথায়? দেবীর ইতিহাস কী? সেই প্রাচীন যুগে দেবী এল কোথা থেকে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। দেবী দুর্গার ঘটনা সবচেয়ে বিশদভাবে লেখা মার্কণ্ডেয় পুরাণের ‘দেবী-মাহাত্ম্যে’ (যাঁকে শ্রীশ্রী চণ্ডী বলা হয়)। অন্য সব পুরাণে দেবীকে পাওয়া যায় অন্যভাবে!

আরও পড়ুন
পেক্সেল

তবে দুর্গা নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দেবীপ্রতিমা। তাঁর দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র, এক পা সিংহের পিঠে, এক পা অসুরের কাঁধে। তাঁকে ঘিরে থাকেন গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর কার্তিক ঠাকুর। যাঁরা সেকেলে কেতায় ঠাকুর বানান, তাঁদের ঠাকুরের পেছনে চালচিত্রে আরও নানা রকম ঠাকুর দেবতার ছবিও আঁকা থাকে। আর যাঁরা আধুনিক, তাঁরা প্রতিমার মাথার ওপর একটি ক্যালেন্ডারের শিবঠাকুর ঝুলিয়ে রাখেন। মোটামুটি এই প্রতিমা বছরের পর বছর ধরে দেখে আমরা অভ্যস্ত।

বর্তমানে যে শারদীয় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়, এই উৎসবকে অনেকে রামায়ণে বর্ণিত দুর্গাপূজার রূপ বলে মনে করেন। মা দুর্গার অকালবোধন এবং এর রামায়ণ যোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। অযোধ্যাপতি রাম ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। ১৪ বছর বনবাসকালে তাঁর স্ত্রী সীতাকে দৈত্যরাজ রাবণ অপহরণ করেন। রাবণের কবল থেকে সীতাকে মুক্ত করার জন্য রাম দৈত্যরাজা বধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভগবান রামচন্দ্র রাবণের প্রাণনাশে সাফল্য অর্জনের জন্য দেবী দুর্গার কৃপা কামনা করেন ও সে জন্য তিনি আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। ঐতিহ্যগতভাবে দেবী দুর্গা বসন্ত ঋতুতে পূজিত হতেন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে রামচন্দ্র শরৎ ঋতুতে দেবীর আশীর্বাদ জন্য প্রার্থনা করেন। যদিও শরৎকাল দেব–দেবীদের ঘুমের সময় বলেই জ্ঞাত। কারণ, এ সময় দিন ছোট ও রাত বড় হয় এবং রাত সাধারণত রাক্ষস জাতির পরিচায়ক বলে গণ্য করা হয়।

আরও পড়ুন
পেক্সেল

প্রথা অনুযায়ী দেবী দুর্গার অষ্টমী বিহিত সন্ধিপূজায় ১০৮টি নীল পদ্মের প্রয়োজন হয়, কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও রামচন্দ্র শুধু ১০৭টি পদ্মের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। এ সময় নিরুপায় হয়ে তিনি ১০৮তম পদ্মস্বরূপ তাঁর নিজের চোখ উপড়ে নিতে উদ্যত হন। কথিত আছে যে পতিতপাবন রামের চোখকে নীল পদ্মের সঙ্গে তুলনা করা হতো বলে তাঁর অপর নাম ছিল ‘পদ্মলোচন’। যাহোক, মা দুর্গা রামের একনিষ্ঠতা দেখে খুশি হয়ে স্বয়ং রামের সামনে আবির্ভূত হন এবং দৈত্যরাজ রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য রামচন্দ্রকে আশীর্বাদ করেন। মা দুর্গার এই অসময়ে আবাহন বাংলায় ‘অকালবোধন’ হিসেবে পরিচিত হয়। তারপর থেকেই শরৎকালে দেবী দুর্গার পূজা প্রচলিত হয়। শরৎকালীন দুর্গাপূজা শারদোৎসব নামে পরিচিত হয় এবং সমস্ত বাঙালি–অধ্যুষিত অঞ্চলে বৃহদাকারে পালিত হয়। বসন্তকালীন দুর্গাপূজা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত, যা ঐতিহ্যগতভাবে মূল দুর্গাপূজা হলেও শারদীয় দুর্গাপূজা উদ্‌যাপনের উন্মাদনায় তা প্রায় হারিয়ে গেছে।

যাহোক, আর্যরীতির সঙ্গে বাঙালির সৃজনশীলতা যুক্ত হয়ে দুর্গোৎসব বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। আনন্দময়ী দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গার আগমনবার্তায় বর্তমানে চরাচর আনন্দমুখর। আমরা দুর্গাপূজা বললেও আসলে এই পূজা মা দুর্গার একার নয়। সঙ্গে আরও অনেকেই আছেন। মা দুর্গা আসেন সবাইকে নিয়েই। ভালো-মন্দ, শত্রু-মিত্র, গাছ-প্রাণী সঙ্গে নিয়েই। চালচিত্রে শিব আছেন, তো পায়ের নিচে অসুর। কলাগাছ বউ তো প্যাঁচা, হাঁস, ইঁদুর, ময়ূরবাহন। হাসিকান্না, সুজন-দুর্জন, পশুপক্ষী-উদ্ভিদ সমাহারে আমাদের জীবনপথ চলাটাকেই সহজ করে চিনিয়ে দিতে চান।

আরও পড়ুন

পৌরাণিক কাহিনি থেকে দুর্গাপূজার শুরু। কিন্তু ক্রমে দুর্গা যেন আমাদের ঘরের মেয়ে হয়ে উঠেছে। সাধারণ মেয়ে, তবে দাপুটে। এই দাপুটে মেয়ের কত নাম! এক অঙ্গে বহুরূপ। এক রূপে বহু নামে চিহ্নিত আমাদের মা দুর্গা। শরৎ ঋতুতে আবাহন হয় বলে দেবীর আরেক নাম শারদীয়া। এ ছাড়া মহিষাসুরমর্দিনী, কাত্যায়নী, শিবানী, ভবানী, আদ্যাশক্তি, চণ্ডী, শতাক্ষী, দুর্গা, উমা, গৌরী, সতী, রুদ্রাণী, কল্যাণী, অম্বিকা, অদ্রিজা—এমন কত নাম আছে মায়ের। ঠিক নানি-দাদিরা যেমন আমাদের আদর করে একটা নামে ডাকে, মামার বাড়িতে আদিখ্যেতা করে অন্য নামে ডাকা হয়। আবার বাবার দেওয়া একটা নাম, মায়ের দেওয়া একটা নাম, স্কুলের জন্য একটা ভালো নাম। মা দুর্গারও তেমনি অনেক নাম। সে তো আমাদেরই ঘরের মেয়ে!

আমরা যদি চণ্ডীর দেবী নির্মাণের ব্যাখ্যা ধরি, নানা শক্তি সমন্বয়ে আজকের ভাষায় তিনি একটি বিশেষ কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বানানো যন্ত্র, একজন নারীবেশী যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া কিছু নন। অসুরের মধ্যে পুরুষের তথাকথিত নারীশরীরের লোভ সঞ্জাত করেছিলেন পৌরাণিকেরা।

তাই দুর্গা নামের যুদ্ধাস্ত্রটি স্ত্রীরূপে শোভিত, এক পুরুষকে প্রলোভন দেখাবে বলেই। যদিও আমাদের ঘরের মেয়ে বা লৌকিক দুর্গার সঙ্গে পৌরাণিক কাহিনির তেমন কোনো মিল নেই। লৌকিক দুর্গা আমাদের ঘরের মেয়ে, চলতি তথাকথিত মেয়েলি সব বৈশিষ্ট্য তাঁর অধিকার। মাকে যেমন একা হাতে অনেক কাজ করতে হয়, ঠিক যেমন মা দুর্গাকে দশ হাতে যুদ্ধ করতে হয়েছিল মহিষাসুর–বধের সময়।

সব দেবতা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল মা দুর্গাকে। অনেকগুলো দৈত্য, দানব, অসুরকে তিনি মেরেছিলেন। আমরা শুধু মহিষাসুরের নামটাই জানি। রক্তবীজ, চণ্ড, মুণ্ড, শুম্ভ, নিশুম্ভ, ধূম্রলোচন, মধু, কৈটভ আর মহিষাসুর, মোট নয়জন অসুরকে মা দুর্গা বধ করেছিলেন। এই এক একজন দুষ্ট অসুর আসলে সমাজের খারাপ লোকেদের প্রতীক। ধরে নেওয়া যায়, এই অসুরদের একজন চোর, একজন ডাকাত, একজন মিথ্যাবাদী, একজন হিংসুটে, একজন মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে, একজন অসৎ, একজন খুনি, একজন প্রতারক আর একজন নিষ্ঠুর লোক। এরা সবাই দুষ্ট আর সমাজের জন্য ক্ষতিকারক মানুষ। তাই বছরে একবার মা দুর্গাকে স্মরণ করে আমরা এসব অশুভ শক্তির বিনাশ করার চেষ্টা করি।

আরও পড়ুন

আমরা যেমন ঘর-সংসার, স্বামী–সন্তান, আত্মীয়–পরিজন ছাড়া কোনো কিছু চিন্তা করতে পারি না, আমরা দুর্গার ক্ষেত্রেও তা–ই দেখতে চেয়েছি। লৌকিক দুর্গা আমাদের মধ্যে দেখা দেন সপরিবার। বাঙালির আপন মনের মাধুরী মেশানো দুর্গা তার সন্তান কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে নিয়ে কৈলাস থেকে হিমালয়ের ঘরে বাপের বাড়ি আসেন। বাঙালির ঘরে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসার মতো আনন্দ। যেমন পরিবারে সবাই আপন, সে রকম জগজ্জননীর বিশ্বসংসারে আমরা শিক্ষিত, অশিক্ষিত, খেটে খাওয়া মানুষ, ব্যবসায়ী বৈশ্য, শাসনকর্তা—সবাই বিশ্বজননীর সন্তান—সরস্বতী, কার্তিক, লক্ষ্মী ও গণেশের মতো সবাই আপন। সন্তানদের কল্যাণের জন্য মা দুর্গা সর্বদাই উদ্গ্রীব। তাই ১০ দিক থেকে সন্তানদের রক্ষা করার জন্য তিনি ১০ হাতে ১০ অস্ত্র ধরেছেন।

তবে বাঙালি যেভাবে দুর্গাপূজাকে আত্মস্থ তথা জীবনের অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছে, তেমনভাবে আর কেই করতে পারেনি। মাতৃরূপে বা শক্তিরূপে মা দুর্গা যেমন বাঙালির অন্তরজুড়ে বিরাজ করছেন, তেমনি কন্যারূপে উমা বাঙালির সংসারে এক অভূতপূর্ব আবেগের সঞ্চার করেছে। কথিত আছে, গিরিরাজ হিমালয় ও তাঁর স্ত্রী মেনকা কন্যা উমা বা পার্বতীকে বিয়ের পর কৈলাসে শিবের ঘরে পাঠিয়েছিলেন।

বৎসারান্তরে সেই কন্যাকে দেখার জন্য মা মেনকার ব্যাকুল প্রার্থনা যেন প্রতিটি বাঙালি পরিবারের সর্বজনীন প্রার্থনায় পরিণত। ঘরের মেয়ে ঘরে আসবে—তাই বাঙালির ঘরে ঘরে দেখা দেয় আনন্দের শিহরণ। আমাদের এই দুঃখ-দৈন্যের ঘরে শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ে আসবে মাত্র চার দিনের জন্য, তাই আর সব দুঃখ ভুলে ঘরে ঘরে আনন্দের পসরা সাজায়, নতুন জামাকাপড় পরে দুঃখকে বিদায় দিয়ে আনন্দময় হয়ে ওঠে বাংলার আকাশ-বাতাস। এভাবে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সামাজিক উৎসবে পরিণত করার ঘটনা পৃথিবীতে আর কোথাও পাওয়া যাবে না। মা দুর্গাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য বাঙালির আগমনী সংগীত আমাদের জীবনপ্রবাহে মিশে যাওয়া এক অবিচ্ছেদ্য ধারা। এর তাৎপর্য হৃদয় দিয়ে, গভীর বোধ দিয়ে অনুভব করতে হয়। 

আরও পড়ুন