মহাপূজা ও মহাদান

দুর্গাপূজা প্রকৃতার্থে দুর্গা মহাপূজা। কারণ, এই পূজাকে কেন্দ্র করে অন্নদান, বস্ত্রদান, অর্থদান, দক্ষিণা ইত্যাদির সংশ্লেষ ঘটে

সনাতন হিন্দুদের বৃহৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে কুম্ভমেলা ও দীপাবলি স্বীকৃতি পেলেও দীর্ঘদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসা পূজার সনদটি শারদীয় দুর্গাপূজার দখলে।

কৃষ্ণা নবমীতে এই পূজা শুরু হয়ে শুক্লা দশমীতে শেষ। চলতি বছরের উদাহরণ বিবেচনায় নিলে ৮ অক্টোবর ২০২৩ রোববার কৃষ্ণপক্ষের নবমীতে শ্রীশ্রী শারদীয় দুর্গা দেবীর কৃষ্ণানবম্যাদি কল্পারম্ভ ও বোধনের জন্য নির্ধারিত ছিল।

দশমী অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর ২০২৩ দুর্গাপূজার সমাপ্তি। পূজার ব্যাপ্তি হলো ১৭ দিন। যদিও সাধারণত ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পূজার অনুষ্ঠান চলমান থাকে। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের যেসব ভক্ত নবরাত্রিক ব্রত পালন করেন, তাঁরা কিন্তু ১৫ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ২৩ অক্টোবর ২০২৩ পর্যন্ত এই ব্রত পালন করবেন।

 দুর্গাপূজার পরিধি ব্যাপক। এ জন্য পূজার মন্ত্রেও একে দুর্গা মহাপূজা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শক্তির আরাধনা করে সমন্বিত সুশক্তির মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন জনশত্রুদের নিরস্ত করার নিমিত্তে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সামাজিক প্রয়াস এই পূজার মাধ্যমে ফুটে ওঠে।

দুর্গাপূজার সূচনালগ্নটিও অর্থবহ। এটি মহালয়া। পিতৃপক্ষের শেষ দিবস। পিতৃ ও মাতৃকুলের পরলোকগত আত্মীয়রা এই সময় পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থান করায় তাঁদের উদ্দেশে তিলতর্পণ নিবেদন করা হয়।

তিলতর্পণ একটি যজ্ঞ। সনাতন ধর্মে ধর্মীয় আয়োজনগুলোর প্রারম্ভে উপস্থিত বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের সম্মতি গ্রহণ করা হয়। তিলতর্পণ যজ্ঞের মাধ্যমে পরলোকগত আত্মীয়রা জল গ্রহণ করে সেই সম্মতি প্রদান করে থাকেন।

 সনাতন ধর্মের মৌল চেতনা বিশ্বজনীন সখ্য। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে সবাই আমার আত্মীয়। এই কারণে সনাতন ধর্মের কল্যাণস্পর্শ থেকে কেউ বঞ্চিত হন না। যাঁর জন্য কেউ চিন্তা করে না, তাঁর জন্যও ধর্মের আশীর্বাণীর জন্য প্রার্থনা ও উপাসনা করা হয়। যেমন মহালয়ার দিনে যাঁর পূর্বপুরুষকে জল অর্পণের কেউ নেই, তিনি বা তাঁরাও জলপ্রাপ্ত হয়েছেন। কারণ, যাঁরা তিলতর্পণ করেছেন, তাঁরা ‘ওঁ আব্রহ্ম স্তম্ভপর্য্যন্তং জগৎ তৃপ্যন্ত’—এই মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে পৃথিবীর সব প্রাণীর জন্য জলের অর্পণায়োজন করেছেন।

সনাতন ধর্মে পরহিত বা গোষ্ঠী কল্যাণের বিষয়টি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ জন্য সর্বজনীন পূজা অনুষ্ঠানে এলাকার সবাই অর্থ দিয়ে অংশ নিয়ে থাকেন। দান সম্পর্কে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ১৭ অধ্যায়ের ২০তম শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—

‘দাতব্যমিতি যদ্দানং দীয়তেহনুপকারিণে।

দেশে কালে চ পাত্রে তদ্দানং সাত্ত্বিকং স্মৃতম।’

প্রত্যুপকারে অসমর্থ বা প্রতিদানে অক্ষম ব্যক্তিকে স্থান, কাল, উপযুক্ততা ইত্যাদি বিবেচনাক্রমে দান করা কর্তব্য, আর এই দানকে বলা হয় সাত্ত্বিক দান। পূজা অনুষ্ঠান ও এতৎসংলগ্ন অনুষ্ঠানসমূহে যে দান করা হবে, তা সাত্ত্বিক দান হবে—এটিই প্রত্যাশিত।

ঋগ্‌বেদে বলা হয়েছে, প্রত্যাশাহীনভাবে অন্যকে যা দান করা হয়, তা বহুগুণ ফিরে আসে (ঋগ্‌বেদ ১-৮)। মানুষের একটি বিশ্বজনীন কর্তব্য বা ধর্ম হোক সম্পদ অহেতুক স্তূপাকার করে নিজের আয়ত্তে রাখার প্রচেষ্টা ও অভাব নিরসনে অন্যের সম্পদ বেহাত করার অপচেষ্টার মধ্যে একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থান তৈরিতে সচেষ্ট থাকা।

সনাতন হিন্দুধর্মমতে, প্রত্যেক সমর্থ মানুষ হবেন প্রকৃতির মতো অর্থাৎ সূর্য, তারা, চন্দ্র, বায়ু, বৃক্ষ ইত্যাদির মতো। প্রকৃতি নির্বিকারভাবে বলে, ‘ইদং নঃ মম’। এটি আমার নয়, এটি সবার। সনাতন ধর্মের ঋষিরা কল্পনা করেছেন, মানুষ হবে মৌমাছির মতো। অনেক কষ্টে মধু সঞ্চয় করে তা পরার্থে যারা দান করে দিতে পারে।

এটি সমাজ সংহতির পরিচায়ক। সনাতন হিন্দুধর্মে এমন লাখ লাখ উদাহরণ আছে, যেখানে প্রতিজ্ঞা রক্ষা, জ্যেষ্ঠ বা পরিবারের মর্যাদা রক্ষায় দান করা হয়েছে। নিজের বা পরিবারের বিপদ, কষ্ট বা দুঃখকে বিবেচনায় আনা হয়নি।

সনাতন ধর্মে দান চারটি বৃহৎ পরিমণ্ডলে দৃশ্যমান—উৎসর্গ, দান, দক্ষিণা ও ভিক্ষা। উৎসর্গ হলো সমন্বিত কল্যাণে দান। যেমন—মন্দির, মঠ, বিদ্যালয় নির্মাণ, পুকুর খনন, রাস্তা নির্মাণ, শিক্ষাব্যবস্থাপনা ইত্যাদি।

দান বিভিন্ন প্রকারের। ভূমিদান, গোদান, বস্ত্রদান, অন্নদান, আশ্রয়দান, বিবাহার্থে দান, বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনার্থে দান।

দক্ষিণা দান ও ফি-এর মিশ্রণ। নির্ধারিত সেবা বা পণ্যের জন্য উপকারভোগী কর্তৃক নির্ধারিত
 দানই দক্ষিণা। এখানে প্রাপক কোনো দাবি বা চার্জ করেন না। দাতা বা প্রদায়ক নিজে তা নির্ধারণ করেন।

 ভিক্ষা হলো উপার্জনবিহীন শ্রেণিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত তাদের সহায়তার জন্য গৃহী তাঁর আয়ের যে অংশ প্রদান করেন।

দুর্গাপূজা প্রকৃতার্থে দুর্গা মহাপূজা। কারণ, এই পূজাকে কেন্দ্র করে অন্নদান, বস্ত্রদান, অর্থদান, দক্ষিণা ইত্যাদির সংশ্লেষ ঘটে। সমবেত পুণ্যার্থীদের উদ্বুদ্ধ করে এই দানের অংশ হিসেবে ‘উত্সর্গ’ করার মতো বা বৃহত্তর ধর্মীয় ও মানবকল্যাণে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, যা গভীরভাবে ভাবতে হবে। ফারসি ঐতিহাসিক আল বিরুনি ১০১৭ খ্রি. থেকে ১৬ বছর ভারতে ছিলেন। তিনি লিখেছেন, সেকালে একজন হিন্দু করদানের পর তাঁর আয়ের এক-নবমাংশ ভিক্ষা বা দানে ব্যবহার করতেন।

দুর্গা মহাপূজা উপলক্ষে সনাতনী কল্যাণব্রতে অনুরূপ চর্চা কি শুরু করা যায় না?

ওঁ তৎ সৎ।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও উপদেষ্টা পুরোহিত, ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পূজামণ্ডপ