দুর্গা: মৃণ্ময় মাঝে চিন্ময়
মানুষ যদি নিজ ধর্মের বাইরে অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কেও কিছুটা জ্ঞান রাখে, তাহলে সমাজে সাম্প্রদায়িকতা অনেকটাই কমে যাবে। অন্য দর্শনেরও যে একটা যৌক্তিক দিক থাকতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করা দরকার। অন্যের দর্শন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়। ফলে একমাত্র নিজের ধর্মই ভালো আর অন্যগুলো সব খারাপ—এ রকম একটা মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে।
‘হিন্দুরা মূর্তি পূজা করে’—অনেক বড় হয়েও এ কথা শুনেছি, অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে উপহাসের পাত্র হয়েছি। তাদের বক্তব্য হলো, ‘তোমরা মাটির তৈরি পুতুলকে শাড়ি পরাও, গয়না পরাও, খাবার দাও, ফুল-জল দাও এবং একসময় সেটা নদীর জলে ডুবিয়ে দিয়ে এসো। কী হাস্যকর ব্যাপার।’ হিন্দুর ঘরে জন্ম নেওয়ার কারণে এ কথাগুলো প্রায়ই শুনতে হতো এবং ভীষণ রকম মন খারাপ হয়ে যেত। স্বামী বিবেকানন্দ বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে:
‘পুতুল পূজা করে না হিন্দু/ কাঠ মাটি দিয়ে গড়া/ মৃণ্ময় মাঝে চিন্ময় হেরে/ হয়ে যাই আত্মহারা’
তার মানে, ‘মূর্তি পূজা’ কথাটাই আসলে ভুল। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস বলে, সর্ব ভূতে ঈশ্বর বিরাজিত। অতএব, মূর্তি বা প্রতিমার মধ্যেও বিরাজিত অর্থাৎ এর মধ্যে যে ঈশ্বর বাস করেন, হিন্দু আসলে তাঁরই পূজা করেন—মূর্তিকে পূজা করেন না। অধিকন্তু ভক্তের কল্পনায় ঈশ্বরের বা দেব-দেবীর যে রূপ, সে রকম একটা অবয়ব তৈরি করে তাতে মন স্থির করলে আরাধনায় একাগ্রতা আসে, একটা পবিত্র আবহ সৃষ্টি হয়।
স্বামী বিবেকানন্দ একবার আলোয়ারের মহারাজের বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন। সেখানে রাজা মূর্তি পূজার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। হঠাৎ স্বামীজির চোখে পড়ল দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে। তিনি বললেন, ‘এটা কার ছবি?’ ভদ্রলোক জানালেন, এটা তাঁর বাবার ছবি। স্বামীজি তখন বললেন, ‘আপনি কি ওই ছবির ওপর থুতু ফেলতে পারেন?’ গৃহকর্তা বললেন, ‘অসম্ভব। আমার বাবার ছবির ওপর আমি থুতু ফেলব কেন?’ বিবেকানন্দ বললেন, ‘অবশ্যই আপনি আপনার বাবার ছবির ওপর থুতু ফেলবেন না। কারণ, এটা আপনার বাবার ছবি। ছবিটা আপনার বাবার প্রতিকৃতি এবং আপনার বাবার মতোই ওই ছবিটাকে আপনি ভক্তি করেন। ঈশ্বর বা দেব-দেবী মানুষের কল্পনায় একটা অবয়ব ধারণ করে এবং কাঠ-মাটি দিয়ে ওই অবয়বের একটা মূর্ত মানুষ তৈরি করে। মানুষ আসলে মূর্তিটিকে পূজা করে না, পূজা করে মূর্তির ভেতরে যে ঈশ্বর বা দেব-দেবীর অবয়ব, তাঁকে।
‘যত্র জীব, তত্র শিব’—এই দর্শনের একটা সাম্যের দিক আছে। মানুষ যদি মানুষকে শিব তথা ঈশ্বর জ্ঞান করেন, তাহলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর হবে। অর্থাৎ মুচি, ব্রাহ্মণ, শূদ্র, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ—সবার মধ্যকার শিবের উপস্থিতি মানুষকে সাম্যের দৃষ্টিতে দেখতে সাহায্য করবে।
মহাভারতে আমরা চমৎকার একটা গল্পের সন্ধান পাই। যেখানে নিচু জাতের সন্তান হওয়ার কারণে দ্রোণাচার্য যখন একলব্যকে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দিতে রাজি হলেন না, তখন একলব্য দ্রোণাচার্যের একটা মূর্তি বানিয়ে সেই ‘মূর্তির কাছে থেকে’ অস্ত্রবিদ্যা রপ্ত করা শুরু করলেন এবং একসময় অর্জুনের সমকক্ষ বা তার চেয়েও বড় ধনুর্বর বনে গেলেন। এই গল্পের মধ্যে একদিকে গুরুভক্তি, অন্যদিকে একাগ্রভাবে সাধনা করলে সিদ্ধি লাভ করা যায়, এই শিক্ষা পাই। তবে আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আরও একটি শিক্ষা হলো আত্মশক্তির জাগরণ।
উপনিষদে মানুষকে ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে অর্থাৎ মানুষ অনন্ত শক্তির আধার। এই অনন্ত শক্তির স্ফুরণ ঘটানোই মূল কাজ। গুরুর কৃপা একটা উপলক্ষমাত্র বা বড়জোর একটা প্রেরণামাত্র। স্বামী বিবেকানন্দ যথার্থই বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে যে শক্তির পরাকাষ্ঠা ইতিমধ্যেই বিদ্যমান, তার প্রকাশ ঘটানোই শিক্ষার উদ্দেশ্য।’
অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষাটা আসতে হবে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে, পিতামাতার কাছ থেকে এবং সমাজ তথা
পরিপার্শ্ব থেকে। এমনকি জাতীয় নেতারা কী রকম আচরণ করেন, তা–ও শিশু-কিশোরদের মনে একটা ছাপ ফেলেঅর্থাৎ জাতীয় নেতারা যদি একটা অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়তে চান, তাহলে তাঁদের আচরণে ও কথাবার্তায় তার নিদর্শন রাখতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ছাড়া সমষ্টির উন্নয়ন হয় না—উন্নয়নের ইতিহাস সে কথাই বলে। অতএব, এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা দরকার, যেখান থেকে শিশু-কিশোরেরা ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে গড়ে উঠবে। এর জন্য নিজ ধর্মের পাশাপাশি অন্য ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র সম্পর্কেও জ্ঞান থাকতে হবে।
● ড. এন এন তরুণ: রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর।