দেবীর হাতে বিনাশ হোক ‘করোনা–অসুর’

মহিষাসুর হিন্দুপুরাণে বর্ণিত আসুরিক ও পাশবিক শক্তিতে বলীয়ান একটি চরিত্র। মহাশক্তিধর এই অসুরশক্তি দেবতাদের দূরীভূত করে দেবলোক দখল করে নেয়। চণ্ডীতে বর্ণিত মহিষাসুরমর্দিনী হলেন আদ্যাশক্তি মহামায়া। দেবকুলের একত্র তেজরশ্মির আলোকপুঞ্জ থেকে আবির্ভূত হন এক দেবীমূর্তি। সব দেবতার অস্ত্রে সুসজ্জিত এই দেবীমূর্তি দশভুজা দুর্গা মহিষাসুর বধ করে দেবলোক পুনরুদ্ধার করেন।

ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য অকালে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন শরৎকালে। সনাতন শাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। সব দুঃখ-কষ্টের বিনাশকারিণী। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ও সমাজ থেকে অশুভশক্তি বিনাশ করে শুভশক্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে অকালবোধনে দশভুজা মা দুর্গার পূজা করে আশ্বিন বা কার্তিকের শুক্লপক্ষে।

প্রতিবারের মতো হিন্দু সম্প্রদায় এবারও দেবীপক্ষের সূচনায় মা দুর্গাকে আবাহন জানাল। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ ও স্বামী শিবকে নিয়ে সপরিবারে কৈলাস থেকে মা এলেন মর্ত্যলোকে তাঁর পিত্রালয়ে। পঞ্জিকামতে, দেবীপক্ষের পাঁচ দিন পর মায়ের অকালবোধন। কিন্তু এ বছর আশ্বিন মাসে দুটি অমাবস্যা পড়ায় এটি ‘মলমাস’। শাস্ত্রমতে, মলমাসে শুভকর্ম নিষিদ্ধ। তাই দেবীপক্ষের সূচনার পাঁচ দিন পর নয়, পঁয়ত্রিশ দিন পর মা এলেন পিত্রালয়ে।

মর্ত্যলোক আজ সর্বগ্রাসী করোনায় আক্রান্ত। পরিসংখ্যান বলছে, করোনা ইতিমধ্যেই পৃথিবী থেকে ১১ লাখ ২১ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ৪ কোটি ৫ লাখ মানুষ। এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা বিশ্ববাসীর অজানা।

মর্ত্যলোকে এবারের অসুর ‘মহিষাসুর’ নয়, ‘করোনাসুর’। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাই এবার সর্বগ্রাসী করোনাসুরকে বধ করে মানবকুলকে রক্ষা করতে আদ্যাশক্তি মা দুর্গার পূজা করবে।

গত বছর বাংলাদেশে ৩১ হাজার ৩৯৮টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হয়েছিল। এবার ঢাকা শহরে পূজামণ্ডপের সংখ্যা ২৩২, সারা দেশে ৩০ হাজার ২১৩। শারদীয় দুর্গোৎসব নয়, এবার হবে শারদীয় দুর্গাপূজা। ৩১ হাজার পূজামণ্ডপের সার্বিক নিয়ন্ত্রক সংগঠন বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ ২৬ দফা কঠোর বিধিমালা দিয়ে বেঁধে দিয়েছে আয়োজক কর্মকর্তাদের; এমনকি ভক্তদেরও। এককথায় শাস্ত্রীয় সব বিধি মেনে দুর্গা মায়ের পূজা হবে, তবে থাকবে না কোনো উৎসবের আয়োজন। গত মার্চ মাস থেকে সারা বিশ্ব থমকে দাঁড়ালেও পৃথিবীজুড়ে কিছু কর্মকাণ্ড তো চলছেই বা চালাতেই হচ্ছে। এ জন্য উদ্ভাবিত হয়েছে বিকল্প পন্থা। সেমিনারের জায়গায় এসেছে ‘ওয়েবিনার’, মিটিং হচ্ছে জুমে, অফিস–আদালত–ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চলছে ‘ভার্চ্যুয়াল’ ব্যবস্থাপনায়। অজপাড়াগাঁ থেকে শহর, এমনকি রাজধানীর বাসিন্দা, সবারই আজ একমাত্র অবলম্বন মোবাইল ফোন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরোপ-আমেরিকার মতো বৈশ্বিক এই অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ আবারও আঘাত হানতে পারে বাংলাদেশে।

সনাতন ধর্মাবলম্বী সব ভক্তের কাছে তাই আকুল আবেদন, আসুন, এবার আমরা সবাই বিকল্প পথে মা দুর্গার আরাধনা করি। ঢাকেশ্বরী কেন্দ্রীয় পূজামণ্ডপ থেকে মায়ের পূজা সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে। উদ্দেশ্য, বাড়িতে বসেই এবার ভক্তরা অঞ্জলি দেবেন মায়ের চরণে। বিভিন্ন পূজামণ্ডপের প্রতিমা ও পূজানুষ্ঠানও সরাসরি দেখাচ্ছে চ্যানেলগুলো, যাতে বাড়িতে বসেই সপরিবারে প্রতিমা দর্শনও করতে পারেন ভক্তরা। পূজা পরিষদের সিদ্ধান্তমতে, ভোগের প্রসাদ থাকছে, তবে থাকছে না হাজার হাজার ভক্তের মধ্যে খিচুড়ি মহাপ্রসাদ বিতরণের মহোৎসব। সুতরাং চলুন, বাড়িতেই খিচুড়ি প্রসাদ রান্না করে মাকে নিবেদন করি এবং সপরিবারে গ্রহণ করি মায়ের প্রসাদ। জীবনটা আপনার, পরিবারটাও আপনার। মা মঙ্গলময়। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। নিশ্চয়ই তিনি গ্রহণ করবেন ভক্তের প্রণাম, অঞ্জলি ও প্রসাদ।

কাজল দেবনাথ: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ

[email protected]