পূজার স্মৃতি প্রকৃতির আকুতি

ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে অঞ্জলির জন্য ভক্তদের ফুল সংগ্রহ
ছবি: প্রথম আলো

পূজার সময় আমাদের বড় আকর্ষণ ছিল দেবসাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত বিচিত্র ভোজে পূর্ণ ঢাউস আকারের ঝলমলে পূজা বার্ষিকীগুলো। অনেকগুলোর নাম এখনো মনে আছে—উদয়ন, নবপত্র, মায়ামুকুর, ঝলমল ইত্যাদি। প্রকাশনার ঠিকানাটাও ভুলিনি—৩৬ ঝামাপুকুর লেন, কলকাতা। ষাট-পঞ্চান্ন বছরের ব্যবধানে ভেতরের পাতাগুলোও মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসাধারণ মুখাবয়ব আর দৃশ্য-পরিস্ফুটন, কেবল কালি-কলমের রেখাঙ্কনে, কখনো সামান্য তুলির ছোঁয়া—কী যে জীবন্ত মনে হতো, যেন গল্পে-পড়া দৃশ্যটাই চোখের সামনে রয়েছে।

নারায়ণ দেবনাথের ছিল নিজ বৈশিষ্ট্য, শৈল চক্রবর্তী এবং আরও কেউ কেউ আঁকতেন পরে। রেবতী আঁকতেন শিবরামের গল্পের ছবি, প্রতি সংখ্যায় থাকত হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনের একটি গল্প। খুদে পাঠকের ভোজে অংশ নিতেন কলকাতার সব নামীদামি লেখক। প্রত্যেকেরই ছিল একটি করে নিজস্ব ধরন। সুকুমার দে সরকার লিখতেন পশুপাখি নিয়ে, নিরুপমা দেবী রূপকথা, সরোজকুমার রায়চৌধুরী ভূতের গল্প, হেমেন্দ্রকুমার রায় ঐতিহাসিক গল্প। এ ছাড়া সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী নানা স্বাদের মজার গল্প লিখতেন। তবে বড় আকর্ষণ ছিল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা-প্যালারামদের গল্প, প্রেমেন্দ্র মিত্রের গপ্পবাজ সরস মানুষ ঘনাদার গল্প আর বিধায়ক ভট্টাচার্যের অমরেশকে নিয়ে লেখা নাটিকা। মাঝে মাঝে থাকত আর্ট পেপারে রঙিন ছবি। মনে পড়ছে, পি সি সরকার প্রতি সংখ্যায় দু–একটা জাদুর কসরত শিখিয়ে দিতেন। আর থাকত বীরত্ব বা সাহসের গল্প। সুনির্মল বসু লিখতেন সুখপাঠ্য কবিতা, কালিদাস রায় ইতিহাসের ঘটনা নিয়ে নীতি-কবিতা, কখনো জসীমউদ্​দীন, বন্দে আলী মিয়ার কবিতা থাকত। আমরা তিন ভাই–বোন খাওয়ার পরে ছুটির দুপুরে কাড়াকাড়ি করে বইটা পড়তাম।

অনেক গল্প অনেকবার করে পড়তাম। আমাদের বাসাটা ছিল বড় রাস্তার লাগোয়া। পশ্চিমের বারান্দায় দাঁড়ালে রাস্তার চলমান যানবাহন ও মানুষ দেখা যেত। সেসব মানুষ দেখাটাও আমাদের একটা অভ্যেস ছিল। পথচারীদের চরিত্র ও তখনকার তাঁদের মনের ভাব নিয়ে নিজ নিজ ধারণাটা বলতাম। নিত্য-দেখা পথচারীদের নিজেদের ধারণা থেকে নামও দিতাম। এক লোকের নাম দিয়েছিলাম ‘তেঁতুলওয়ালার শরবত’, যদিও লোকটা মোটেও তেঁতুলের শরবত বিক্রি করত না, চলত সাইকেলে, কিন্তু চেহারাটায় তেঁতুল-খাওয়া ভাব ফুটে থাকত। রাস্তার চলা ছবির সঙ্গে পূজার সম্পর্কটা এবার বলছি।

আমাদের বাসার আশপাশে আর কোনো শিক্ষিত বাঙালি পরিবার ছিল না। বিকেলে মাঠে খেলতাম ধোপাপাড়া আর বস্তির ছেলেদের সঙ্গে। কাছেপিঠে পূজার পাট ছিল না। তবে বিসর্জনের দিন সামনের রাস্তা দিয়ে সারি বেঁধে ট্রাকে দেবীর প্রতিমা নিয়ে পূজারিরা যেত গান-বাদ্য বাজিয়ে। প্রায়ই এ রাস্তায় এসে যেন ট্রাকগুলো একটু থামত—হয়তো অন্যদের অপেক্ষায়, কিংবা ট্রাকের সারি ঠিক করার জন্য। আর ওই ফাঁকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অষ্টভুজা দেবী দুর্গার প্রতিমার সৌন্দর্য ও সাজ দেখতাম। তিনি সব সময় বিত্তশালী। অসুর বধে নিরত থাকলেও বেশির ভাগ চেহারাই হতো কমনীয়, লাবণ্যময়। অন্তত ছোটদের চোখে তেমনটাই মনে হতো।

পূজার সময়টা আরেকভাবেও উপভোগ করতাম। আমাদের শৈশবে শহরেও ঋতু পরিবর্তন বোঝা যেত। প্রাক্​–স্কুল পর্বের একটি বইতে পড়েছিলাম দুই পঙ্​ক্তির দুটি ছড়া, আজও মনে পড়ে, ‘শরৎকালেতে হয় শোভা-চমৎকার/ লতায়-পাতায় ফুল ফোটে চারি ধার’ এবং ‘ভূতনাথ অনুকূল এসো দুজন/ পূজার সময় পরো নূতন ভূষণ’। সম্ভবত প্রথমটায় ত ও ৎ এর ধ্বনিমাধুর্য এবং দ্বিতীয়টায় ঊকারের ব্যবহার শিখিয়েছেন লেখক। এই মাধুর্যের কারণে এ রকম আরও অনেক ছড়া-কণিকা মুখস্থ রয়ে গেছে। এই দুটোই উল্লেখ করলাম; কারণ, এতে শরৎকাল ও দুর্গাপূজা দুটির কথাই রয়েছে।

আজন্ম নগরলালিত হলেও আজও শরতের রূপ সমান মুগ্ধ করে। বর্ষার উদার দক্ষিণায় সম্পন্না প্রকৃতি তার যৌবনের সবটা লাবণ্য এ সময় ফুটিয়ে তোলে—সে একেবারে আকাশ থেকে পায়ের নিচের ঘাস পর্যন্ত। বর্ষার আচ্ছন্নতা কাটিয়ে প্রচ্ছন্নতার আড়াল ঘুচিয়ে হঠাৎ যেন আকাশ-পৃথিবীজুড়ে আলোর রহস্য বয়ে যায়। প্রকৃতির মহৎ ও নগণ্য প্রতিটি সদস্যই জেগে উঠে যেন সম্ভাষণ জানায়, ভাব বিনিময় করতে চায়।

এখন তিন ফসলার কালে ‘ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি’ সর্বত্র দেখা যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু ঝকমকে নীল আকাশ, তাতে সাদা মেঘের ভেলার দেখা এখনো মেলে, মেঘ ও রৌদ্র আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি করে, কাশ এখনো টিকে আছে—নদীর চরে, পাহাড়ের গায়ে। শরতের আলোকোজ্জ্বলতায় রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধতা বারবার প্রকাশ পেয়েছে—গানে, ছিন্নপত্রে, কখনো গল্পের বর্ণনাংশে।

রবীন্দ্রনাথ বত্রিশটা গান বেঁধেছেন শরৎ নিয়ে; প্রতিটি অপূর্ব, আনন্দ এবং মুগ্ধতার মধ্যেও অন্তরের অব্যক্ত আকুতির কী অপরূপ প্রকাশ ঘটান গানে গানে। বলছেন, ‘আজি শরৎ তপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়, সেই চাওয়া এগুতে থাকে পরতে পরতে শরতের অপরূপ রূপের মায়ায় জড়িয়ে নিতে নিতে।’ বলছেন, ‘আজ প্রথম ফুলের পাব প্রসাদখানি, তাই ভোরে উঠেছি। শেষে কী হয়?—আজ সকালবেলায় ছেলেখেলার ছলে সকল শিকল টুটেছি।’ আহা, আজ মানুষ বড্ড শিকলে বাঁধছে একে-অপরকে। কত-কত তার শিকল—প্রাসাদসম অট্টালিকা থেকে ছোট্ট মুঠো ফোন তক্ কত তার বন্ধন।

আচ্ছা, কাজের জিনিসটা কাজের জন্যই থাক না, প্রয়োজনটুকু মেটাতে তো বাধা নেই, কিন্তু তার অনুষঙ্গ কেন এত ব্যাপক, এত প্রকট হবে? তাতে মানুষটা কেবল শিকল-বাঁধা হচ্ছে তা নয়, তার জগৎ কেবলই অলীক ও ছোট হচ্ছে। এভাবে মানবের বামনায়ন মেনে নেওয়া যায়!

হিন্দু বাঙালি দুর্গাপূজায় মেতে উঠুক, উৎসবের রঙে রাঙুক, তখন সম্প্রদায়ের গ্রিল ভেঙে উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে যাবে—এমনটাই হওয়া উচিত। কেনই–বা হিন্দু-মুসলমান সব বাঙালি মিলে শরতের এমন সুন্দর আলোকোজ্জ্বল একটি দিনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসবে মেতে উঠবে না? আবারও রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হব, তাঁর কথা ধার করেই বলি,‘সংসারে প্রতিদিন আমরা সত্যকে স্বার্থের বিক্ষিপ্ততায় ভুলে থাকি, উৎসবের বিশেষ দিনে সেই অখণ্ড সত্যকে উপলব্ধির দিন, স্বীকার করার দিন।’ কারণ, উৎসব মানুষকে পরস্পরের সাথে মেলায়, এ যে সৌহার্দ্যবোধ, তাই রবীন্দ্রনাথ মনে করেন উৎসব ‘স্বার্থপরতার সুদৃঢ় জালকে অনায়াসে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া দেয়’।

আমরা কেন স্বার্থের জালে জড়াচ্ছি কেবল? এখনো কি বুঝব না মানবজাতি এবং তার বসতি এই গ্রহটিকে রক্ষা করতে হলে প্রকৃতিচর্চা হতে হবে জীবন সংস্কৃতির অঙ্গ। তাই বলি বিভিন্ন ঋতুতে আনন্দময় প্রেমময় মিলনান্ত ব্যঞ্জনার ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালির উৎসব কেন নয়?

আবুল মোমেন, কবি ও সাংবাদিক।