বাঙালির জীবন ও দুর্গাপূজা

মহাসপ্তমীতে রাজশাহী নগরের প্রতিশ্রুতি মণ্ডপে ভক্তদের দেবীবন্দনা
ছবি: শহীদুল ইসলাম

পূজা ও উপাসনার অর্থ হলো ঈশ্বরকে অবলম্বন করে জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস। ঈশ্বরকে মাতৃভাবে পূজা ও উপাসনা করা সনাতন সংস্কৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্য।

শ্রীশ্রী দুর্গাপূজা মাতৃভাবে ঈশ্বরের উপাসনা ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মানুষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত।

পুরাণকথন অনুযায়ী, সূর্যের দক্ষিণায়নে দেবতারা থাকেন নিদ্রিত, উত্তরায়ণে জাগ্রত। শরতে দেবতাদের বিশ্রামের পালা। শ্রীরামচন্দ্র দুষ্ট রাবণকে বধের জন্য বিশ্রামের সময় দেবী দুর্গাকে জাগিয়ে পূজা করেছিলেন, দুর্গাপূজার প্রারম্ভিক অঙ্গানুষ্ঠান তাই অকালবোধন নামে পরিচিত। তারই ধারাবাহিকতায় শরতে দুর্গাপূজার প্রচলন। শাস্ত্রমতে, শ্রীশ্রী দুর্গাপূজায় সাতটি কল্প (প্রকার) থাকলেও আশ্বিনের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত কল্পে (তৃতীয় কল্প) বিহিত পূজা সর্বাধিক প্রচলিত। বিবিধ অঙ্গানুষ্ঠানের বৈচিত্র্যময় সমাবেশ, বিশেষত স্নাপন (স্নান), পূজন, বলি ও হোম—এ চারটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যের আয়োজন, তাই এ পূজানুষ্ঠান মহাপূজা। পূজার প্রতিটি অঙ্গানুষ্ঠান পৃথক পৃথক তাৎপর্যমণ্ডিত। তন্মধ্যে, স্নাপন, পূজন, বলি ও হোমের তাৎপর্য প্রসঙ্গত আলোচনা করা যেতে পারে।

নবপত্রিকা (নয়টি বৃক্ষের অঙ্গাংশ নিয়ে তৈরি নবপত্রিকা দেবী দুর্গারই জগৎরূপ) ও দেবী দুর্গার মহাস্নান পর্বে বিভিন্ন স্থানের ও বিভিন্ন প্রকারের জল ও মাটি দিয়ে দেবতাকে দর্পণে স্নান করানো হয়। স্নানের উদ্দেশ্য—শুদ্ধতা ও পবিত্রতা সম্পাদন, এটা স্বতঃসিদ্ধ। দেবী তো শুদ্ধতা ও পবিত্রাস্বরূপিণী, তাঁকে আবার স্নান করিয়ে শুদ্ধ করার প্রয়োজন কী? প্রকৃতপক্ষে, সংসারের বিষয়-চিন্তায় আমরা জগজ্জননীকে ভুলে থাকি। আমাদের মন বিষয়–মলিনতায় অশুদ্ধ থাকে। পুষ্পজল দিয়ে স্নান করাতে করাতে সাধক-পূজারির চিন্তন ও মন্ত্রোচ্চারণ—‘মৃত্তিকাস্থিত হে কচ্চি (কচুগাছ-নবপত্রিকা দুর্গার অঙ্গ), তুমি সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িনী, দুর্গারূপে স্নাত হয়ে তুমি বিজয় দান করো।’ জল ও মৃত্তিকা দিয়ে স্নান করানোর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রূপ ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত দেবীকেই চিন্তন করা হয়। স্নানে পবিত্রাস্বরূপিণী মাকে চিন্তনের মধ্য দিয়ে বিষয়দুষ্ট মনকেই শুদ্ধ ও
পবিত্র করার প্রয়াস পান সাধক। রাজদ্বার থেকে বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা, শিশিরজল থেকে সাগরজল—জগতের সর্ব ক্ষেত্রের জল ও মাটি দিয়ে স্নান করানোর মধ্য দিয়ে সর্বত্র তিনিই ব্যাপ্ত হয়ে আছেন—এরূপ ভাবনা ও উপলব্ধির প্রয়াস পান সাধক। স্থান পবিত্র ও পরিষ্কার থাকলে তবেই বসবাসের উপযোগী হয়, দেবতার আসন গ্রহণের জন্যও হৃদয়মন্দির পবিত্র ও শুদ্ধ হওয়া চাই। স্বচ্ছ জলালয়েই প্রতিবিম্ব স্পষ্ট প্রত্যক্ষ হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, ‘তিনি (ঈশ্বর) বিষয়বুদ্ধির অগোচর, কিন্তু শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধির গোচর। শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধি আর শুদ্ধ আত্মা—একই জিনিস।’

ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে অনুষ্ঠেয় সাধারণ কিন্তু অত্যাবশ্যক অঙ্গানুষ্ঠান—ষোড়শোপচারে (আসন, স্বাগত, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, পুনরাচমনীয়, স্নানীয়, বস্ত্র, ভূষণ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য ও বন্দনা) পূজা হয়। গৃহে কোনো শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি এলে নানা আয়োজনে তাঁকে অভ্যর্থনা করা হয়, তাঁর পছন্দের দ্রব্যাদি দিয়ে যত্নের সঙ্গে সেবা করা হয়, তাঁকে আনন্দ দেওয়ার ও তাঁর প্রীতলাভের চেষ্টা করা হয়, জগন্মাতার আগমনে পূজায়ও যেন তদ্রূপ।

শাস্ত্রজ্ঞরা বলে থাকেন, ভক্তিসহকারে এসব উপচারদ্রব্য উপাস্য দেবতাকে সমর্পণ করলে তা সাধককে দেবসন্নিধানে নিয়ে যায় বা বাঞ্ছিত ফলকে নিকটে এনে দেয় বলে উল্লিখিত দ্রব্যাদিকে উপচার বলা হয়। পূজারি-সাধক বাইরে যেসব দ্রব্য প্রতিমাকে নিবেদন করেন, মনে মনেও সেসব চিন্ময়ী মাকে নিবেদন করেন।

অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজায় বলির অনুষ্ঠান। বলিতে সাত্ত্বিক, রাজসিক, স্থূল, সূক্ষ্ম (মনোবৃত্তি) ইত্যাদি প্রকারভেদ আছে। সাত্ত্বিক পূজারি বলির মাধ্যমে মনে মনে (সূক্ষ্মভাবে) কামাদি রিপুর বিনাশ চিন্তা করেন।

হোম মহাপূজার অন্যতম অঙ্গানুষ্ঠান।হোমের স্থূল, সূক্ষ্ম ইত্যাদি প্রকার রয়েছে। হোমের লক্ষ্য ভেদবিলোপ। স্থূল হোমে যেমন হোমকাষ্ঠ, ঘৃত, পুষ্প, ফলাদি বিভিন্ন হোমদ্রব্য অগ্নিতে দগ্ধ হয়ে অগ্নিময় হয়ে যায়, তেমনি সূক্ষ্ম হোমে দ্রবণীয় দ্রব্যের অর্পণ, ঘৃত, হোমাগ্নি, আহুতিদানের কর্তা, হোমক্রিয়া, হোমে প্রাপ্তব্য ফলকে উপাস্য (ব্রহ্ম) থেকে অভিন্নজ্ঞান করেন পূজারি সাধক।

ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্যমণ্ডিত অঙ্গানুষ্ঠানের সন্নিবেশে অনুষ্ঠেয় এ পূজা যেন এক নিরন্তর ধ্যানপরায়ণতা, তাঁরই (ভগবতীরই) শরণাগত হওয়ার এবং তাঁরই সান্নিধ্য বা স্বরূপ লাভের প্রয়াস। পূজানুষ্ঠান চার বা পাঁচ দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার ক্ষেত্রে পূজার অন্তর্নিহিত ভাব জীবনে চালিকা শক্তি ও সাধনার উপাদানস্বরূপ মনে করেন সাধকেরা। তত্ত্বজ্ঞ সাধকের কাছে জীবনটাই পূজারূপে পরিগণিত হয়।

ভক্তের ভাব—মায়ের প্রতি শিশুর সম্পর্কের ভাব। শিশু যেন সর্বদা মায়ের শরণাগত, মায়ের সঙ্গে যুক্ত সব সময়। ভাবে, মা আছেন, সঠিক পথ দেখিয়ে দেবেন; মা আমার হাত ধরে আছেন, অতএব কোনো ভয় নেই। শরণাগত ভক্ত মায়ের সন্নিধানে যুক্ত থেকে জয় করেন ভয় ও বিপর্যয়কে। সাধারণের তত্ত্ব নয়, ফল প্রত্যাশিত। শাস্ত্র আশ্বস্ত করছে, এ পূজায় ধর্ম, অর্থ, কাম, মোহ—চতুর্বর্গ ফল লাভ হয়। শ্রীশ্রী চণ্ডীর আখ্যানে আছে, মহামায়ার কৃপায় রাজা সুরথ হৃত রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন।

জগৎসংসারের দুঃখ-ভয়ও আমাদের ব্যথিত ও বিপর্যস্ত করে। তত্ত্বজ্ঞ সাধক বিচার করে দেখেন, পরিবর্তনশীল জগতের সবই ক্ষণস্থায়ী, এই আছে, এই নেই—যেন স্বপ্নবৎ, তাই জাগতিক ঐশ্বর্য তাঁর কাছে প্রত্যাশিত নয়। জগৎরূপ স্বপ্ন বা ভ্রম থেকে মুক্তি চান তিনি। জগন্মাতাও সাধকের অভীষ্ট অনুসারে ভ্রম বা স্বপ্ন দূর করে দেন। সাধক উপলব্ধি করেন—এক মা-ই সর্বত্র বিরাজিতা, নিজেও মা থেকে অভিন্ন।

●স্বামী দেবধ্যানানন্দ, রামকৃষ্ণ মঠ, ঢাকা।