মুমিনের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো তাকওয়া। ইখলাস ও তাকওয়া সফলতার মানদণ্ড। তাকওয়া হলো আল্লাহর ভালোবাসা হারানোর ভয়, আল্লাহর অসন্তোষের ভয়। প্রকৃত মুমিন তাকওয়া দ্বারাই পরিচালিত হন। তাকওয়া মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে এবং সৎকাজে অনুপ্রাণিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা যারা ইমান এনেছ, তারা তাকওয়া অর্জন করো।’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৭০)। কোরআন কারিমে বলা হয়েছে, ‘যারা ইমান আনল এবং তাকওয়া অর্জন করল, তারা আল্লাহর বন্ধু; তাদের কোনো ভয় নেই, তারা চিন্তিতও হবে না (সুরা-১০ ইউনুস, আয়াত: ৬২)।’
‘রমজান’-এর আভিধানিক অর্থ অগ্নিদগ্ধ করা, ভস্মীভূত হওয়া। এ মাসে রোজা পালনের মাধ্যমে ক্ষুধায় উদর পোড়ে, তৃষ্ণায় বুক জ্বলে। ক্ষুধা-পিপাসার দহন জ্বালায় নফসকে দাহন করে পরিশুদ্ধ ও পাপমুক্ত করা রোজার মূল লক্ষ্য। এটিকে কোরআনের ভাষায় তাকওয়া বা খোদাভীতি বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের প্রতিও, যাতে তোমরা তাকওয়া (খোদাভীতি) লাভ করতে পারো (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৩)।’
কলব বা অন্তরের রোজা হলো তাকওয়া। রমজানে রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় রোজাদার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সব প্রকার বৈধ পানাহার ও যৌনসম্ভোগ থেকে বিরত থাকেন। তাঁরা নির্জন-নিরালায় দরজা-জানালা বন্ধ ঘরে গোপন স্থানে সংগোপনেও পানাহার তথা রোজার বিপরীত কোনো কাজ করেন না
তাকওয়াবান ব্যক্তিকে বলা হয় মুত্তাকিন, যার বহুবচন হলো মুত্তাকুন। তাকওয়া শব্দের একটি প্রতিশব্দ হলো ‘খওফ’। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা তার রবের সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করল, তাদের জন্য রয়েছে দুইটি করে জান্নাত (সুরা-৫৫ আর রহমান, আয়াত: ৪৬)।’ তাকওয়া শব্দের অন্য একটি প্রতিশব্দ হলো ‘খাশিয়াত’। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন, ‘তুমি শুধু তাকেই সতর্ক করতে পারো, যে উপদেশ (কোরআন) মেনে চলে এবং না দেখেও দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে। তুমি তাকে ক্ষমা ও সম্মানজনক পুরস্কারের সুসংবাদ দাও (সুরা-৩৬ ইয়াছিন, আয়াত: ১১)।’
মানুষের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান নিয়ামত হলো হিদায়াত। হিদায়াতপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত হলো তাকওয়া। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বললেন, ‘এই কোরআন মুত্তাকিদের জন্য হিদায়াত (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২)।’ আল্লাহ তাআলা সুরা ফাতিহায় মানুষকে হিদায়াতের প্রার্থনা শিখিয়েছেন, ‘আমাদের সঠিক সরল পথ দেখান (সুরা-১ ফাতিহা, আয়াত: ৪)।’
তাকওয়া মানে সাবধানতা, সতর্কতা, আত্মরক্ষা। ষড়রিপু—কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য—মানুষের মানবীয় ইতিবাচক গুণাবলির শত্রু। যেসব নেতিবাচক গুণ বা বৈশিষ্ট্য মানুষের জ্ঞানকে বাধাগ্রস্ত করে, তাদের বলা হয় রিপু বা শত্রু। এরা মূলত জ্ঞানের শত্রু। এগুলো মানব প্রবৃত্তিরই অংশ। এসবের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে সুসভ্য ও উন্নততর করে। এগুলোর যথেচ্ছ ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে পশুরও অধম করে দেয়, অধঃপতনের অতলে নিমজ্জিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি বহু জিন ও ইনসানকে জাহান্নামের জন্য বানিয়েছি, তাদের অন্তর আছে কিন্তু অনুধাবন করে না, চোখ আছে কিন্তু দেখে না, কান রয়েছে কিন্তু শ্রবণ করে না; তারা পশুতুল্য, বরং তার চেয়ে নিকৃষ্ট; তারা গাফিল (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ১৭৯)।’
রমজানের উদ্দেশ্য হলো ষড়্রিপুর ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভের নৈতিক শক্তি অর্জন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা এভাবে আল্লাহর ইবাদত করো যেন তোমরা তাকে দেখছ; যদিও তোমরা তাঁকে দেখতে না পাও, তবে নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের দেখছেন (বুখারি, খণ্ড: ১, হাদিস: ৪৮)।’ পঞ্চেন্দ্রিয়—চোখ, কান, নাক, জিব, ত্বকসহ দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক সংযত ব্যবহার নিশ্চিত করাই হলো রোজা। দেহ ও মনকে অন্যায় ও নিষিদ্ধ কাজ-বস্তু থেকে বিরত রাখাই রোজার উদ্দেশ্য। আজীবন এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার সক্ষমতা অর্জন করাই হলো রোজার সফলতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানবদেহে এমন একটি গোশতের টুকরা আছে, যা পরিশুদ্ধ হলে তার পুরো শরীর সঠিকভাবে কাজ করে; আর তা যদি বিনষ্ট হয়, তার পুরো দেহই বিনষ্ট হয়; জেনে রাখো তা হলো কলব (বুখারি, খণ্ড: ১, হাদিস: ৫০)।’
কলব বা অন্তরের রোজা হলো তাকওয়া। রমজানে রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় রোজাদার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সব ধরনের বৈধ পানাহার ও যৌনসম্ভোগ থেকে বিরত থাকেন। তাঁরা নির্জন-নিরালায় দরজা-জানালা বন্ধ ঘরে গোপন স্থানে সংগোপনেও পানাহার তথা রোজার বিপরীত কোনো কাজ করেন না। এভাবেই সব কাজে সব সময় সব অবস্থায় নেক আমলের জন্য কষ্ট, সহিষ্ণুতা ও পাপ বর্জনের জন্য মানসিক দৃঢ় মনোবল অর্জনই রোজার বাস্তব শিক্ষা তথা তাকওয়ার প্রশিক্ষণ।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম