একটি ভয়াবহ সত্য
দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন। তাঁর চেহারায় উদ্বেগের ছাপ। সাহাবিরা অপেক্ষা করছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এই দুজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। অথচ তারা বড় কোনো গুনাহের জন্য শাস্তি পাচ্ছে না।’
সাহাবিরা অবাক। বড় গুনাহ নয়, তাহলে?
রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তাদের একজন পেশাব থেকে পবিত্রতা অর্জন করত না। আর অপরজন মানুষের মধ্যে চোগলখোরি করে বেড়াত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২১৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯২)
এই দুটি বিষয়ের জন্য কবরে শাস্তি! একজনের কারণ ছিল পেশাব থেকে ভালোভাবে পবিত্র না হওয়া।
তোমরা পেশাব থেকে খুব সতর্কতার সঙ্গে পবিত্রতা অর্জন করো। কেননা কবরের অধিকাংশ আজাব এই কারণেই হয়ে থাকে।সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৪৮
আরেকটি হাদিসে আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পেশাব থেকে খুব সতর্কতার সঙ্গে পবিত্রতা অর্জন করো। কেননা কবরের অধিকাংশ আজাব এই কারণেই হয়ে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৪৮)
কবরের অধিকাংশ আজাব শুধু এই একটি কারণে।
এ হাদিস শুনে আমাদের চমকে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা কি সত্যিই পবিত্রতা অর্জনের ব্যাপারে সতর্ক?
আমাদের বাস্তবতা
ঢাকা শহরের একটি সাধারণ ফ্ল্যাটের কথা ভাবুন। ৭০০ বা ৮০০ বর্গফুটের ছোট্ট বাসা। একটিমাত্র ওয়াশরুম। সেখানেই টয়লেট, সেখানেই গোসল, সেখানেই অজু। পরিবারে হয়তো একজন বৃদ্ধ আছেন, যাঁর পক্ষে সব সময় টয়লেটে সঠিকভাবে বসা সম্ভব হয় নয় কিংবা একটি ছোট শিশু, যে এখনো টয়লেট ব্যবহারের নিয়ম শেখেনি।
মেঝেতে কখনো কখনো পেশাব পড়ে যেতে পারে। আর আমরা? সেই একই মেঝেতে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন পাঁচবার অজু করি।
টয়লেট ব্যবহারের পর ঠিকমতো পবিত্রতা অর্জন করি কি? পেশাবের ছিটা থেকে সতর্ক থাকি কি? বিষয়টা এতই সাধারণ মনে হয় যে আমরা এটা নিয়ে ভাবিই না।
পেশাবের ছিটা: যা চোখে দেখা যায় না
আধুনিক বিজ্ঞান এ বিষয়ে যে তথ্য দিচ্ছে, দাঁড়িয়ে পেশাব করলে পেশাবের অতি সূক্ষ্ম ছিটা ছড়িয়ে পড়ে। এগুলো কাপড়ে, পায়ে, এমনকি শরীরের বিভিন্ন অংশে লেগে যায়, যা খালি চোখে দেখা যায় না।
টয়লেট ফ্লাশ করার সময় পেশাবের অতি সূক্ষ্ম কণা বাতাসে মিশে যায় এবং ছয় ফুট দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এগুলো দেয়ালে, মেঝেতে ও আশপাশের সব পৃষ্ঠে জমা হয় (Best, E. L., & Sandoe, J. A., 2012, American Journal of Infection Control, 40(4), pp. 375-382)
পাবলিক টয়লেটে ফ্লাশ করার ফলে তৈরি এই এরোসল কণার গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে দুই মিটার পর্যন্ত হতে পারে এবং মাত্র আট সেকেন্ডের মধ্যে এগুলো সিলিংয়ের উচ্চতায় পৌঁছে যায় (Wang, Y. et al., 2022, PLOS ONE, 17(3), e0265983)
বাথরুমের মেঝেতে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে গড়ে প্রায় দুই মিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যার উল্লেখযোগ্য অংশ আসে মানুষের মলমূত্র থেকে (Flores, G. E. et al., 2011, PLOS ONE, 6(11), e28132)
অর্থাৎ পেশাবের যে ছিটা আমরা দেখি না, সেগুলোই আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। যদিও যে ‘ছিটা’ চোখে দেখা যায় না কিংবা মেঝে বা দেয়াল যদি ভেজা না থাকে তাহলে তাকে অপবিত্র ভাবার কারণ নাই। কিন্তু তাতে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
যদিও যে ‘ছিটা’ চোখে দেখা যায় না কিংবা মেঝে বা দেয়াল যদি ভেজা না থাকে তাহলে তাকে অপবিত্র ভাবার কারণ নাই। কিন্তু তাতে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
পবিত্রতার গুরুত্ব
ইসলামে পবিত্রতা শুধু একটি বাহ্যিক বিষয় নয়। এটি ইমানের অঙ্গ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পবিত্রতা ইমানের অর্ধেক।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২২৩)
আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২২২)
আরেক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং তোমার পোশাক পবিত্র রাখো।’ (সুরা মুদ্দাসসির, আয়াত: ৪)
কোবার মানুষদের সতর্কতা
মদিনা থেকে কয়েক মাইল দূরে ছিল একটি ছোট্ট জনপদ, যার নাম কোবা। সেখানকার মানুষদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, তাঁরা পবিত্রতার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন।
আল্লাহ তাঁদের প্রশংসা করে কোরআনে আয়াত নাজিল করলেন, ‘প্রথম দিন থেকে যে মসজিদ তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেটিই তোমার নামাজ পড়ার জন্য অধিক উপযুক্ত। সেখানে এমন মানুষ আছে, যাঁরা পবিত্র হতে ভালোবাসে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ১০৮)
আল্লাহ তাঁদের ভালোবাসেন! কিয়ামত পর্যন্ত কোরআন তিলাওয়াত হবে, আর স্মরণ হবে এই পবিত্রতাপ্রেমী মানুষদের কথা।
আমরা কী করব
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সতর্কবাণী ও কুবার মানুষদের উদাহরণ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। পেশাব থেকে সম্পূর্ণ পবিত্রতা অর্জন করতে হবে। এর জন্য কিছু ব্যবহারিক পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
পেশাবের সময়
দাঁড়িয়ে পেশাব করার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। বসে পেশাব করতে হবে। এতে ছিটা পড়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বসে পেশাব করতেন (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১২; সুনানে নাসায়ি, হাদিস: ২৯)
পেশাব শেষে তিনবার পুরুষাঙ্গ ঝেড়ে নিতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ পেশাব করে, সে যেন তার পুরুষাঙ্গ তিনবার ঝেড়ে নেয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩২৬)
পেশাবের পর পানি দিয়ে ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করা উত্তম। টয়লেট টিস্যু দিয়ে পরিষ্কার হওয়া যায়, তবে পানি ব্যবহার করলে অধিক পরিচ্ছন্নতা ও নিশ্চয়তা পাওয়া যায়।
শেষে পর হাত সাবান দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
ওয়াশরুমে অজুর সময়
অজুর আগে ওয়াশরুমের মেঝেতে প্রচুর পানি ঢেলে পরিষ্কার করে নিন। বিশেষ করে যেখানে দাঁড়িয়ে অজু করবেন, সেই জায়গাটুকু ভালো করে ধুয়ে নিন। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে।
অজুর জন্য আলাদা এক জোড়া স্যান্ডেল বা জুতা রাখুন। টয়লেট ব্যবহারের জুতা এবং অজুর জুতা যেন আলাদা থাকে।
অজুর সময় ছোট মগ ব্যবহার করুন। সরাসরি কলের নিচে অজু করলে পানি ছিটে মেঝেতে পড়ে এবং সেই পানি আবার গায়ে ও কাপড়ে লাগতে পারে। মগ দিয়ে সাবধানে পানি ব্যবহার করলে এ সমস্যা এড়ানো যায়।
অজু শেষে কাপড় ও শরীর পরীক্ষা করুন। কোথাও সন্দেহজনক ছিটা লাগলে ধুয়ে ফেলুন।
এসব করতে প্রতিদিন কয়েক মিনিট সময় বেশি লাগবে। কিন্তু ভাবুন তো—যদি এই কয়েক মিনিট কবরের আজাব থেকে বাঁচায়? আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের উপায় হয়?
ঘরের ওয়াশরুমে
পরিবারের শিশু ও বয়স্কদের বিষয়ে সচেতন থাকুন। তাঁদের যথাসাধ্য বুঝিয়ে বলুন। তাঁরা হয়তো পুরোপুরি বুঝবেন না, কিন্তু আপনি নিজে সচেতন থাকতে পারবেন।
ফ্লাশ করার আগে টয়লেটের ঢাকনা বন্ধ করার অভ্যাস করুন। এতে এরোসল কণা ছড়ানো অনেকটা কমে যায় (Johnson, D. L. et al., 2013, American Journal of Infection Control, 41(3), pp. 254-258)
নিয়মিত ওয়াশরুম পরিষ্কার রাখুন। বিশেষত মেঝে ও টয়লেট প্যানের আশপাশ।
ওয়াশরুমে সাবান কিংবা হ্যান্ডওয়াশ ও পরিষ্কার তোয়ালে রাখুন। পবিত্রতা অর্জনের পর হাত ভালোভাবে ধোয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা
এসব পরামর্শ মেনে চললে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে ও পবিত্রতা অর্জন সহজ হবে। তবে মনে রাখতে হবে, সাধারণ ফ্ল্যাটের ওয়াশরুম যেখানে নিয়মিত পানি ব্যবহার হয়, গোসল হয়, সেখানকার মেঝে সাধারণত পবিত্র বলে গণ্য হয়। কারণ, শরিয়তের নিয়ম হল, কোনো কিছুর মূল অবস্থা পবিত্র। নাপাক প্রমাণ ছাড়া কিছু নাপাক হয় না।
তবে স্বাস্থ্যগত দিক থেকে এবং পবিত্রতা নিশ্চিত করার জন্য ওপরের সতর্কতাগুলো মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।
হ্যাঁ, এসব করতে প্রতিদিন কয়েক মিনিট সময় বেশি লাগবে। কিন্তু ভাবুন তো—যদি এই কয়েক মিনিট কবরের আজাব থেকে বাঁচায়? আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের উপায় হয়?
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কবরের অধিকাংশ আজাব পেশাব থেকে পবিত্রতা অর্জন না করার কারণে।’ এ একটি হাদিসই যথেষ্ট আমাদের সতর্ক হওয়ার জন্য।
পবিত্রতা শুধু শরীরের বাইরের বিষয় নয়, এটি ইমানের পরিচয়। তাকওয়ার নিদর্শন। যে ব্যক্তি চোখে দেখা যায় না—এমন পেশাবের ছিটার ব্যাপারেও সচেতন, তাঁর অন্তর কতটা জাগ্রত, ভাবুন একবার।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে পেশাব থেকে সম্পূর্ণ পবিত্রতা অর্জনের তওফিক দিন। কুবার সেই পবিত্রতাপ্রেমী মানুষদের মতো বানান। কবরের আজাব থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
মুহাম্মাদ মুহসিন মাশকুর: খণ্ডকালীন শিক্ষক, আরবি বিভাগ, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।