আল্লাহর কোন নামের কী মহিমা

আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ নাম ‘আল্লাহ’ছবি: ফ্রিপিক

মহান আল্লাহর পরিচয় লাভ করা ইবাদতের মূল নির্যাস। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “আল্লাহর রয়েছে চমৎকার সব নাম, তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাকো।” (সুরা আরাফ, আয়াত: ১৮০)

আল্লাহর প্রতিটি নাম তাঁর একেকটি বিশেষ গুণের বহিঃপ্রকাশ। এই নামগুলো সঠিকভাবে বুঝতে পারলে একজন মানুষের সঙ্গে তাঁর রবের সম্পর্ক কেবল ভয়ের নয়, বরং গভীর ভালোবাসা ও অসীম নির্ভরতার হয়ে ওঠে।

মহান সত্তার মৌলিক ও গুণবাচক নামসমূহ

আল্লাহ: এটি মহান রবের সত্তাগত নাম, যা অন্য কারো জন্য ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তিনি ছাড়া সত্য কোনো মাবুদ নেই এবং আসমান-জমিনের সবকিছু তাঁরই অনুগত। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, এটি এমন এক নাম যা সব গুণের আধার। (আল-মাকসাদুল আসনা, পৃষ্ঠা: ৬০, মাকতাবাতুল জান্দি, কায়রো, ১৯৬৮)

আর-রাহমান  ও আর-রাহিম: উভয় নামই আল্লাহর অসীম রহমত বা দয়াকে নির্দেশ করে। ‘রহমান’ দ্বারা বোঝায় তাঁর দয়া সত্তাগতভাবে পূর্ণ, আর ‘রাহিম’ দ্বারা বোঝায় তাঁর সেই দয়া সৃষ্টির ওপর বর্ষিত হয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা আল্লাহকে ‘আল্লাহ’ নামে ডাকো অথবা ‘রাহমান’ নামে ডাকো, যে নামেই ডাকো না কেন, সব সুন্দর নাম তাঁরই।” (সুরা ইসরা, আয়াত: ১১০)

আল-মালিক: তিনি নিখিল বিশ্বের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। আসমান ও জমিনের যা কিছু আছে সবই তাঁর গোলাম বা দাস হিসেবে তাঁর কাছে উপস্থিত হবে। (সুরা মারইয়াম, আয়াত: ৯৩)

আল-কুদ্দুস: তিনি সব ধরনের ত্রুটি ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত। ফেরেশতা ও মুমিনদের তসবিহ বা পবিত্রতা ঘোষণার মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো এই নাম।

আস-সালাম: যাঁর পক্ষ থেকে কোনো অনিষ্ট আসে না, বরং যাঁর কাছে কেবল শান্তি ও সন্তুষ্টির আশা করা যায়।

আল-মু’মিন: যিনি ভয় ও অস্থিরতা দূর করে নিরাপত্তা ও প্রশান্তি দান করেন। তিনি কোরাইশদের ক্ষুধা থেকে অন্ন দিয়েছিলেন এবং ভয় থেকে অভয় দিয়েছিলেন। (সুরা কুরাইশ, আয়াত: ৪)

আল্লাহর রয়েছে চমৎকার সব নাম, তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাকো।
কোরআন, সুরা আরাফ, আয়াত: ১৮০

আল-মুহায়মিন: যাঁর জ্ঞান ও কর্তৃত্ব থেকে কোনো কিছুই গোপন নয়। তিনি সমগ্র মহাবিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করেন।

আল-আজিজদ: তিনি মহাপরাক্রমশালী, যাঁর ওপর কেউ জয়ী হতে পারে না। প্রকৃত ইজ্জত বা সম্মান কেবল তাঁরই জন্য (সুরা ফাতির, আয়াত: ১০)।

আল-জাব্বার: তিনি সৃষ্টির ঊর্ধ্বে এবং সবকিছুর ওপর নিজের ফয়সালা কার্যকরকারী। সৃষ্টি ও আদেশ—সবই তাঁর হাতে। (সুরা আরাফ, আয়াত: ৫৪)

আল-মুতাকাব্বির: তিনি সৃষ্টির সাধারণ গুণাবলির অনেক ঊর্ধ্বে। এই বড়ত্ব বা কিবরিয়া কেবল আল্লাহরই অধিকার। মানুষের জন্য অহংকার করা হারাম, কিন্তু আল্লাহর জন্য এটি তাঁর মহিমার প্রকাশ।

আরও পড়ুন

সৃষ্টিজগত ও রিজিকের আধার যে নামসমূহ

আল-খালিক, আল-বারি ও আল-মুসাওয়ির: এই তিনটি নাম সৃষ্টির বিভিন্ন স্তর নির্দেশ করে। আল্লাহ শূন্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন (খালিক), প্রাণ দান করেছেন (বারি) এবং প্রতিটি সৃষ্টিকে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও অবয়ব দিয়েছেন (মুসাওয়ির)। মানুষের চেহারার ভিন্নতা কিংবা আঙুলের ছাপের স্বাতন্ত্র্য আল্লাহর ‘মুসাওয়ির’ নামেরই এক অনন্য নিদর্শন। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬)

আল-গাফফার: বান্দার বারবার অবাধ্যতা সত্ত্বেও যিনি বারবার ক্ষমা করেন। ‘গাফর’ শব্দের মূল অর্থ হলো ঢেকে রাখা বা গোপন করা। তিনি বান্দার পাপকে দুনিয়া ও আখেরাতে গোপন রাখেন।

আল-কাহহার: যাঁর ইচ্ছার সামনে কোনো মানুষ বা ফেরেশতার আপত্তি চলে না। তিনি গ্রহ-নক্ষত্রকে যেমন কক্ষপথে পরিচালনা করেন, তেমনি নবীদেরও উচ্চ মাকাম দান করেন।

আল-ওয়াহহাব: যিনি প্রতিদান ছাড়াই অগণিত নেয়ামত দান করেন। সব অনুগ্রহ আল্লাহরই হাতে, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৭৩)

আর-রাজ্জাক: যিনি প্রতিটি প্রাণীর কাছে তার প্রয়োজনীয় খাদ্য পৌঁছে দেন। তিনি আহার দান করেন কিন্তু নিজে আহার গ্রহণ করেন না। (সুরা জারিয়াত, আয়াত: ৫৮)

আল-ফাত্তাহ: যিনি জ্ঞান ও রিজিকের বন্ধ দুয়ার খুলে দেন। আল্লাহর রহমতের দুয়ার কেউ বন্ধ করতে পারে না। (সুরা ফাতির, আয়াত: ২)

আল-কাবিদ ও আল-বাসিত: তিনি তাঁর প্রজ্ঞা অনুযায়ী কারো রিজিক সংকুচিত করেন, আবার কারো জন্য তা প্রশস্ত করেন (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৬২)। ঠিক একইভাবে তিনি ‘আল-খাফিদ’ (অবনতকারী) ও ‘আর-রাফি’ (উন্নতকারী), ‘আল-মুয়িজ’ (সম্মানদাতা) ও ‘আল-মুজিল’ (লাঞ্ছনাদাতা)। পার্থিব রাজত্বের চাকচিক্য সাময়িক; আখেরাতে আল্লাহই চূড়ান্তভাবে উচ্চ ও নিচু নির্ধারণ করবেন। (সুরা ওয়াকিয়া, আয়াত: ১-৩)

তিনি পরম সহিষ্ণু। মানুষের অবাধ্যতা সত্ত্বেও তিনি সঙ্গে সঙ্গে আজাব দেন না, বরং সংশোধনের সুযোগ দেন।

জ্ঞান, বিচার ও প্রজ্ঞার পরিচয়

আস-সামি ও আল-বাসির: ফিসফিস করে বলা কথা যেমন তিনি শোনেন, অন্ধকারের ক্ষুদ্রতম নড়াচড়াও তিনি দেখেন। মুসা (আ.) যখন ফেরাউনের কাছে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন, আল্লাহ অভয় দিয়ে বলেছিলেন, “ভয় পেয়ো না, আমি তোমাদের সঙ্গেই আছি, আমি শুনি ও দেখি। (সুরা তহা, আয়াত: ৪৬)

আল-হাকাম ও আল-আদল: তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক। দুনিয়াতে মানুষের বিচারে ভুল থাকতে পারে, কিন্তু আল্লাহর বিচারে কোনো অবিচার নেই। তিনি কিয়ামতের দিন চূড়ান্ত ফয়সালা করবেন। (সুরা আনআম, আয়াত: ১১৪)

আল-লতিফ ও আল-খাবির: আল্লাহ অত্যন্ত সূক্ষ্ম কৌশলে তাঁর কাজ সম্পন্ন করেন। ইউসুফ (আ.)-এর জীবনের কঠিন পরীক্ষাগুলো শেষে তিনি বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই আমার রব যা ইচ্ছা করেন তা সুচারুভাবে (লতিফ) সম্পাদন করেন” (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ১০০)। ‘খাবির’ অর্থ তিনি অন্তরের গোপন রহস্য সম্পর্কেও সম্যক অবগত।

আল-হালিম: তিনি পরম সহিষ্ণু। মানুষের অবাধ্যতা সত্ত্বেও তিনি সঙ্গে সঙ্গে আজাব দেন না, বরং সংশোধনের সুযোগ দেন। (সুরা নাহল, আয়াত: ৬১)

আল-আজিম, আল-গাফুর ও আশ-শাকুর: তিনি মহান ও ক্ষমাশীল। বান্দার সামান্য ভালো কাজের বিপরীতেও তিনি অনেক বেশি সওয়াব ও শুকরিয়া বা মূল্যায়ন করেন।

আরও পড়ুন

আল্লাহর মাহাত্ম্য ও অভিভাবকত্ব

আল-আলি, আল-কাবির, আল-হাফিজ, আল-মুকিত ও আল-হাসিব: আল্লাহ সবকিছুর ঊর্ধ্বে মহান। তিনি আমানত রক্ষা করেন (হাফিজ) এবং ছোট-বড় সবার খাদ্যের সংস্থান করেন (মুকিত)। যারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তাদের জন্য তিনিই যথেষ্ট। (সুরা জুমার, আয়াত: ২৬)

আল-জালিল, আল-কারিম, আর-রাকিব, আল-মুজিব ও আল-ওয়াসি: আল্লাহ দয়া ও মহিমার আধার। তিনি প্রার্থনায় সাড়া দেন (সুরা শুরা, আয়াত: ২৬) এবং তাঁর রহমত ও জ্ঞান সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে।

আল-হাকিম, আল-ওয়াদুদ, আল-মাজিদ, আল-বাইস ও আশ-শাহিদ: আল্লাহর কোনো কাজই নিরর্থক নয় (হাকিম)। তিনি বান্দার প্রতি অতিশয় মমতাশীল (ওয়াদুদ)। তিনি কিয়ামতের দিন মৃতদের পুনর্জীবিত করবেন (বাইস) এবং তিনি সবকিছুর প্রত্যক্ষদর্শী। (সুরা বুরুজ, আয়াত: ৯)

আল-হাক্ক, আল-ওয়াকিল, আল-কাউয়ি, আল-মাতিন ও আল-ওয়ালি: আল্লাহর অস্তিত্বই একমাত্র চিরন্তন সত্য। তিনি আমাদের সব কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন (ওয়াকিল) এবং তাঁর ক্ষমতা অজেয়। তিনি মুমিনদের অভিভাবক।

আল-হামিদ, আল-মুহসি, আল-মুবদি, আল-মুঈদ, আল-মুহয়ি, আল-মুমিত, আল-হাইয়ু, আল-কাইয়ুম, আল-ওয়াজিদ ও আল-মাজিদ: আল্লাহ প্রশংসিত ও সবকিছুর হিসাব গ্রহণকারী। তিনি সৃষ্টি শুরু করেন এবং পুনরায় সৃষ্টি করবেন (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ১০৪)। তিনি চিরঞ্জীব ও সবকিছুর ধারক।

আল্লাহর প্রতিটি নাম আমাদের শেখায় যে আমরা এক অসীম দয়ালু ও শক্তিশালী সত্তার তত্ত্বাবধানে আছি।

একত্ববাদ ও ক্ষমতার শীর্ষ নামসমূহ

আল-ওয়াহিদ, আল-আহাদ, আস-সামাদ, আল-কাদির ও আল-মুকতাদির: আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, বরং সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। তাঁর অসাধ্য কিছুই নেই।

আল-মুকাদ্দিম, আল-মুয়াখখির, আল-আউয়াল, আল-আখির ও আজ-জহির: তিনি সময় ও স্থানের ঊর্ধ্বে। সৃষ্টির শুরু থেকে শেষে কেবল তিনিই থাকবেন।

আল-বাতিন, আল-ওয়ালি, আল-মুতালি, আল-বার ও আত-তাওয়াব: তিনি চোখের আড়ালে থেকেও সর্বত্র বিরাজমান। তিনি পরম দাতা এবং বান্দার তওবা কবুলকারী।

আল-মুনতাকিম, আল-আফু, আর-রাউফ, মালিকুল মুলক ও জুল-জালালি ওয়াল-ইকরাম: তিনি অপরাধীদের শাস্তিদাতা কিন্তু ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। তিনি দয়া করে মানুষের ওপর বোঝা সহজ করে দেন (সুরা নিসা, আয়াত: ২৮)। সব রাজত্বের মালিক কেবল তিনিই।

আল-মুকসিত, আল-জামি, আল-মানি, আদ-দার, আন-নাফি, আন-নুর, আল-হাদি, আল-বাদি, আল-বাকি ও আল-ওয়ারিস: আল্লাহ ইনসাফকারী এবং হাশরের ময়দানে সবাইকে একত্রকারী। ক্ষতি ও লাভ কেবল তাঁরই হাতে (সুরা নাজম, আয়াত: ৪৩-৪৪)। তিনি অন্ধকারের আলো এবং অদ্বিতীয় উদ্ভাবক। সবকিছুর ধ্বংস শেষে কেবল তিনিই অবশিষ্ট থাকবেন (সুরা কাসাস, আয়াত: ৮৮)।

আর-রাশিদ ও আস-সাবুর: তিনি মানুষকে কল্যাণের পথ দেখান। তিনি পরম ধৈর্যশীল; বান্দার পাপাচার দেখেও তিনি লজ্জিত করেন না। তবে তাঁর এই ধৈর্য যেন আমাদের উদাসীন না করে, কারণ তাঁর হিসাব গ্রহণ অত্যন্ত নিখুঁত। (সূত্র: ইবনুল কাইয়িম, বাদায়িউল ফাওয়াইদ, ১/১৬৪, মাকতাবাতু নিযার মুস্তফা আল-বায, মক্কা, ১৯৯৬)।

আসমাউল হুসনা কেবল উচ্চারণের জন্য নয়, বরং উপলব্ধির জন্য। ইমাম গাজালি (রহ.)-এর মতে, একজন মুমিনের সাফল্য তখনই আসে যখন সে এই নামগুলোর গুণাবলি নিজের জীবনে চর্চা করার চেষ্টা করে।

যেমন—আল্লাহর ক্ষমাশীলতা থেকে ক্ষমা করা এবং তাঁর উদারতা থেকে দান করা শেখা। আল্লাহর প্রতিটি নাম আমাদের শেখায় যে আমরা এক অসীম দয়ালু ও শক্তিশালী সত্তার তত্ত্বাবধানে আছি। এই বিশ্বাসই মানুষের অন্তরের ভয় দূর করে এবং তাকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।

আরও পড়ুন