মুসলিম সভ্যতায় শিক্ষাবৃত্তি–০২
যেভাবে গড়ল ইসলামি জ্ঞানচর্চার অর্থনৈতিক ভিত্তি
এক সময় মুসলিম সমাজ শিক্ষাকে গ্রহণ করেছিল পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে এবং শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য ছিল বৃত্তির ব্যবস্থা। এই বৃত্তি জ্ঞানের প্রচারে যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়ও হয়েছে শক্তিশালী হাতিয়ার। মুসলিম সভ্যতায় শিক্ষাবৃত্তি কার্যক্রম সম্পর্কে আল–জাজিরা অবলম্বনে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রবন্ধের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
বাগদাদের দজলা নদীর তীরে, একটি মাদরাসার চত্বরে বসে আছে শিক্ষার্থীরা। তাদের হাতে কলম আর কাগজ, অপলক তাকিয়ে আছে সামনে শিক্ষকের মুখের দিকে। শিক্ষক, একজন প্রখ্যাত ফকিহ, কোরআনের তাফসির ব্যাখ্যা করছেন। এই শিক্ষার্থীদের অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন—কেউ নিশাপুর থেকে, কেউ দামেস্ক থেকে। তাদের থাকার জায়গা, খাবার, এমনকি কাগজ-কলমের খরচও বহন করছে একটি ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান, যা একজন ধনী বণিক বা শাসক দান করেছেন। এই দৃশ্য ইসলামি সভ্যতায় শিক্ষাবৃত্তির প্রাতিষ্ঠানিক রূপের একটি প্রতিচ্ছবি।
এই পর্বে আমরা শিক্ষাবৃত্তির প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ, ওয়াকফের ভূমিকা এবং এর বিভিন্ন রূপ নিয়ে আলোচনা করব। নিজামিয়া মাদরাসার মতো প্রতিষ্ঠান কীভাবে শিক্ষাবৃত্তিকে একটি সংগঠিত রূপ দেয়, তাও আমরা দেখব।
বাগদাদের মুস্তানসিরিয়া মাদরাসার ওয়াকফের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯০০,০০০ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা), যা আজকের হিসেবে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান।
শিক্ষাবৃত্তির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ: মাদরাসা ও মসজিদ
ইসলামের প্রথম শতাব্দীতে শিক্ষা মূলত ছিল মসজিদকেন্দ্রিক। মদিনার মসজিদে নববী, মক্কার মসজিদুল হারাম এবং দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ ছিল জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্র। তবে সভ্যতার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার চাহিদা বাড়ে এবং মাদরাসা নামে স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এই মাদরাসাগুলো শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই নয়, ফলিত বিজ্ঞান, চিকিৎসা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো বিষয়ও শেখাত।
বাগদাদের মুস্তানসিরিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয় ১২৩৩ খ্রিষ্টাব্দে। এই মাদরাসা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবৃত্তির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এই মাদরাসার জন্য বিপুল ওয়াকফ বরাদ্দ করা হয়েছিল, যা শিক্ষকদের বেতন, শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া এবং শিক্ষা সামগ্রীর খরচ মেটাত।
ইমাম আয-যাহাবি (মৃ. ১৩৪৭ খ্রি.) বলেন, এই মাদরাসার ওয়াকফের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯০০,০০০ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা), যা আজকের হিসেবে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান। তিনি আরও বলেন, “দামেস্কের মহান মসজিদের সমান ওয়াকফ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।” (তারিখ আল-ইসলাম, খণ্ড ৪৫, পৃ. ১২৩, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৯৪)
নিজামিয়া মাদরাসা, যা ১০৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয়, শিক্ষাবৃত্তির প্রাতিষ্ঠানিক রূপের আরেকটি মাইলফলক। সেলজুক মন্ত্রী নিজামুল মুলক (মৃ. ১০৯২ খ্রি.) এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যার শাখা বাগদাদ, নিশাপুর, ইসফাহান, মার্ভ ও বলখের মতো শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।
এই মাদরাসাগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, থাকার ব্যবস্থা এবং নিয়মিত ভাতা প্রদান করত। ইমাম আল-গাযালি (মৃ. ১১১১ খ্রি.) এই মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরে এখানে শিক্ষকতাও করেন, যা তার জ্ঞানভিত্তিক অবদানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। (আল-সুবকি, তাবাকাত আশ-শাফিইয়্যা, খণ্ড ৪, পৃ. ১০১, কায়রো: দারুল মা’আরিফ, ১৯৬৪)
নিজামিয়া মাদরাসা শিক্ষাকে একটি সংগঠিত, রাষ্ট্রপৃষ্ঠপোষিত ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করে, যা ইসলামি সভ্যতার জ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতির জন্য মেরুদণ্ড হয়ে ওঠে।
ওয়াকফ থেকে শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া, শিক্ষকদের বেতন এবং শিক্ষা সামগ্রীর খরচ মেটানো হতো। এই বৃত্তি শুধু ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। দরিদ্র শিক্ষার্থীরাও উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারতেন।
ওয়াকফ: শিক্ষাবৃত্তির অর্থনৈতিক ভিত্তি
ইসলামি শিক্ষাবৃত্তির সাফল্যের পেছনে ছিল ওয়াকফ বা ধর্মীয় উইল। ওয়াকফ ছিল এমন সম্পত্তি বা আয়, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বা দরিদ্রদের কল্যাণে চিরস্থায়ীভাবে দান করা হতো। এই ওয়াকফ থেকে শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া, শিক্ষকদের বেতন এবং শিক্ষা সামগ্রীর খরচ মেটানো হতো। দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের ‘কুব্বাত আয়েশা’ নামে একটি বিশেষ কক্ষ ছিল, যেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য বই ও অন্যান্য শিক্ষা সামগ্রী সংরক্ষণ করা হতো। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, খণ্ড ৮, পৃ. ২৩৪, বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৯৮৮)
ওয়াকফের মাধ্যমে শিক্ষাবৃত্তি শুধু ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। দরিদ্র শিক্ষার্থীরাও উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারতেন। বাগদাদের হানবালি ফকিহ মাজদুদ্দিন উবায়দুল্লাহ ইবনে আলি (মৃ. ১২০৩ খ্রি.) ‘দারুল ইলম’ নামে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন এবং এটি শিক্ষার্থীদের জন্য ওয়াকফ করেন। (ইবনে আল-নাজ্জার, তাতিম্মা যাইল তারিখ বাগদাদ, খণ্ড ৩, পৃ. ১৫৬, বাগদাদ: দারুল কুতুব, ১৯৩৫)
এই ওয়াকফগুলো শিক্ষাকে একটি সর্বজনীন অধিকারে পরিণত করে।
ওয়াকফের আরেকটি উদাহরণ হলো ফিরোজাবাদের (বর্তমান ইরান) দারুল কুতুব, যা বুয়াইদ মন্ত্রী বাহরাম ইবনে মাফিন্না (মৃ. ১০৪৩ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। এই গ্রন্থাগারে ১০,০০০ পাণ্ডুলিপি ছিল, যার মধ্যে ৪,০০০ ছিল বিখ্যাত খাত্তাত ইবনে মুকলা (মৃ. ৯৩৯ খ্রি.)-এর হস্তলিপিতে তৈরি। (সিবত ইবনে আল-জাওযি, মিরআত আয-যামান, খণ্ড ৮, পৃ. ৪৫৬, দামেস্ক: দারুল মুস্তফা, ১৯৮৪)
এই গ্রন্থাগার শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল, ফলে জ্ঞানচর্চা সেখানে ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়।
শিক্ষাবৃত্তির বিভিন্ন রূপ
ইসলামি শিক্ষাবৃত্তি শুধু ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেয়েছে, যেমন:
১. একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্য পুরস্কার: শিক্ষার্থীরা তাদের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য আর্থিক পুরস্কার পেতেন। আইয়ুবি শাসক মুআযযাম ঈসা ইবনে আল-আদিল (মৃ. ১২২৭ খ্রি.) দামেস্কে শিক্ষার্থীদের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন। যারা যামাখশারি (মৃ. ১১৪৩ খ্রি.)-এর আল-মুফাসসাল ফি ইলম আল-আরাবিয়্যা পড়ে শেষ করতেন, তারা ১০০ দিনার পেতেন এবং মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ-শাইবানি (মৃ. ৮০৫ খ্রি.)-এর আল-জামি আল-কাবির পড়লে পেতেন ২০০ দিনার। (আল-যাহাবি, সিয়ার আলাম আল-নুবালা, খণ্ড ১২, পৃ. ৫৬৭, বৈরুত: মুআসসাসাত আল-রিসালা, ১৯৮৫)
২. গবেষণা ও রচনার জন্য বৃত্তি: শিক্ষক ও পণ্ডিতরা গবেষণা ও বই লেখার জন্য আর্থিক সহায়তা পেতেন। আব্বাসি মন্ত্রী ফাতহ ইবনে খাকান (মৃ. ৮৬১ খ্রি.) সাহিত্যিক আল-জাহিজ (মৃ. ৮৬৯ খ্রি.)-কে এক বছরের জন্য পূর্ণ বেতন অগ্রীম দেন যাতে তিনি কিতাব আর-রদ্দ আলা আন-নাসারা (খ্রিষ্ট ধর্মবিশ্বাসীদের খণ্ডন) লিখতে পারেন। (ইবনে আল-নাদিম, আল-ফিহরিস্ত, পৃ. ১৮৯, বৈরুত: দারুল মা’আরিফ, ১৯৯৫)
৩. শিক্ষা সামগ্রী ও জীবিকার জন্য সহায়তা: শিক্ষার্থীদের বই, কাগজ, কালি, এবং জীবিকার জন্য ওয়াকফ থেকে সহায়তা দেওয়া হতো। নিশাপুরের হাফিজ আবু সালিহ আল-মুয়াযযিন (মৃ. ১০৭৭ খ্রি.) শিক্ষার্থীদের জন্য হাদিসের বই ও কাগজ-কালির ওয়াকফের তত্ত্বাবধান করতেন। (ইয়াকুত আল-হামাভি, মুজাম আল-উদাবা, খণ্ড ৩, পৃ. ৪৫৬, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৯৩)
৪. পোশাক ও অন্যান্য সহায়তা: কখনো শিক্ষার্থীদের পোশাক বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীও দেওয়া হতো। ১৪২৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের কালবুর্গির শাসক হানাফি আলেম আলাউদ্দিন ইবনে আল-বুখারি (মৃ. ১৪৩৭ খ্রি.)-এর কাছে ৩,০০০টি শাল (উচ্চমানের কাপড়) পাঠান, যার মধ্যে ১,০০০ শাল তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করেন। (আল-মাকরিযি, আস-সুলুক, খণ্ড ৪, পৃ. ৮৯০, কায়রো: দারুল কুতুব, ১৯৭২)
আইয়ুবি শাসক দামেস্কে শিক্ষার্থীদের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন। যারা যামাখশারির আল-মুফাসসাল ফি ইলম আল-আরাবিয়্যা পড়ে শেষ করতেন, তারা ১০০ দিনার আর শাইবানির আল-জামি আল-কাবির পড়লে পেতেন ২০০ দিনার।
শিক্ষাবৃত্তি ও সভ্যতার অগ্রগতি
শিক্ষাবৃত্তি শুধু জ্ঞান প্রচার করেনি, বরং সভ্যতার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মাদরাসাগুলো ছিল জ্ঞানের কেন্দ্র, যেখানে ধর্মীয় ও ফলিত বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটত। মুস্তানসিরিয়া মাদরাসায় ফিকহ ও হাদিসের পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞান শেখানো হতো। এই মাদরাসার গ্রন্থাগারে এমন বই ছিল, যার তুল্য পৃথিবীতে আর কোথাও ছিল না। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া, খণ্ড ১৩, পৃ. ১২৩)।
শিক্ষাবৃত্তি ইসলামি সমাজের স্থিতিস্থাপকতারও প্রমাণ দেয়। মোঙ্গল আক্রমণের (১২৫৮ খ্রি.) সময়েও বাগদাদে মুস্তানসিরিয়া মাদরাসার নির্মাণ কাজ চলছিল। এই শিক্ষাবৃত্তির শক্তি ইসলামি সমাজকে রাজনৈতিক পরাজয়ের মুখে সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভিত্তিক বিজয় অর্জনে সক্ষম করে। ইমাম আয-যাহাবি বলেন, “শিক্ষাবৃত্তি ছিল মুসলিম সমাজ প্রগতিশীল থাকার একটি প্রধান কারণ।” (তারিখ আল-ইসলাম, খণ্ড ৪৫, পৃ. ১২৫)।
মুসলিম সভ্যতায় শিক্ষাবৃত্তি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে মাদরাসা ও ওয়াকফের মাধ্যমে। নিজামিয়া ও মুস্তানসিরিয়ার মতো মাদরাসাগুলো শিক্ষাকে সংগঠিত ও সর্বজনীন করে তোলে, যখন ওয়াকফ শিক্ষার অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রদান করে। শিক্ষাবৃত্তির বিভিন্ন রূপ—একাডেমিক পুরস্কার থেকে গবেষণা বৃত্তি—ইসলামি সমাজের জ্ঞানভিত্তিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
পরবর্তী পর্বে আমরা শিক্ষাবৃত্তিতে অমুসলিমদের অবদান এবং আধুনিক প্রেক্ষাপটে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।