পার্থিব জাঁকজমক যেন আধ্যাত্মিকতার বাধা না হয়
উৎসবের কোলাহল, আতশবাজির শব্দ, ছোট্ট মসজিদের ওপরে উঁচু ভবনের ছায়া, কেনাকাটার উন্মাদনা, ফ্যাশন ও ভোগবাদের প্রতি আসক্তি—এসবই আমাদের আধুনিক জীবনের পরিচিত চিত্র। শিক্ষিত মানুষেরা কঠোর পরিশ্রম করে ডিগ্রি অর্জন করছে, কিন্তু তা প্রায়ই কাগজে লিখিত সম্মান, স্বীকৃতি, পদ–পদবি ও ক্ষমতার জন্য। বাড়িঘর ক্রমেই বড় ও ব্যয়বহুল হচ্ছে, দরিদ্ররা পিছিয়ে পড়ছে। পার্টি, সংগীত, নাচ, নারী–পুরুষের অবাধ মেলামেশা—এসব রাতের গভীরে তাহাজ্জুদ নামাজের আধ্যাত্মিকতা ভুলিয়ে দিচ্ছে।
নতুন জীবনধারা, ব্যয়বহুল শখ, ফ্যাশনের প্রতিযোগিতা—এসব এখন আমাদের দুনিয়ার অংশ। এতে নতুনত্ব কিছু নেই। তবে এই দুনিয়ার আকর্ষণ থেকে মুক্তি পাওয়া ও আখিরাতের জন্য জীবন গড়ার পথ কীভাবে খুঁজে পাব আমরা?
নবীজির (সা.) আদর্শ
মহানবী (সা.)–এর যুগেও দুনিয়ার এই চাকচিক্য বিদ্যমান ছিল। তৎকালীন সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরমে পৌঁছেছিল, দরিদ্ররা উপেক্ষিত ছিল, দয়ার মূল্য কম লোকে বুঝত। ধনী কুরাইশরা ভাবত, তাদের সম্পদ দিয়ে তারা জান্নাত কিনে নিতে পারবে। আজকের দিনেও আমরা একই চিত্র দেখি, শুধু আধুনিকতার ছদ্মবেশে।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর সামনে এই দুনিয়াকে নিজের করে নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তিনি বারবার তা থেকে মুখ ফিরিয়েছেন, একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করেছেন। তিনি দুনিয়ার দায়িত্ব ও আখিরাতের প্রতি নিষ্ঠার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। তিনি খাবার পেলে তা উপভোগ করতেন, প্রয়োজনে রোজা রাখতেন। তিনি একাকী নামাজ ও প্রার্থনায় সময় কাটাতেন, আবার পরিবার ও সঙ্গীদের সঙ্গেও সময় ভাগ করে নিতেন। তিনি ইসলাম প্রচারে কঠোর পরিশ্রম করতেন, যুদ্ধে অংশ নিতেন, কিন্তু বিশ্রামের প্রয়োজন হলে ঘুমাতেন। বলা হয়, ‘তাঁর পায়ের কাছে দুনিয়া ছিল, কিন্তু তাঁর নামে একটি দিনারও (স্বর্ণমুদ্রা) ছিল না।’ তাঁর মৃত্যুর সময় তিনি তাঁর স্ত্রী আয়েশা (রা.)–কে তাঁর শেষ সাত দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) দান করতে বলেছিলেন, যাতে আল্লাহ তাঁকে এই সম্পদের জন্য প্রশ্ন না করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,০৯৮)
দুনিয়ার মোহ থেকে সতর্কতা
দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ থেকে দূরে থাকা সহজ নয়। আমরা মাঝেমধ্যে বিনোদন, স্বীকৃতি, বড় বাড়ি বা বিলাসবহুল জীবনের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু এই আকর্ষণ আমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে নিয়ে যায়। আলী (রা.) বলেছেন, ‘দুনিয়া তার প্রলোভন দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করে, তার মিথ্যা আশায় মানুষকে ধ্বংস করে। এটি এমন এক নববধূর মতো, যার প্রতি সবার দৃষ্টি, সবার হৃদয় মুগ্ধ।’ (আবু নু’আইম, আল–হিলিয়াহ, ২/১৩৫-১৩৬)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়া অভিশপ্ত, এতে যা কিছু আছে, তা অভিশপ্ত, কেবল আল্লাহর স্মরণ, তাঁর নৈকট্য লাভের কাজ, জ্ঞানী ব্যক্তি ও জ্ঞানের শিক্ষার্থী ব্যতীত।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৩২২)
সত্যিকার মূল্যবান বস্তু কী
এখন সময় দানের। দান আমাদের সেসব দরিদ্রের কথা মনে করিয়ে দেয়, যাঁরা তাঁদের ধৈর্যের কারণে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। এখন সময় জ্ঞান ভাগাভাগির; উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের অহংকারে অন্যদের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা উচিত নয়। এখন সময় শিশু ও দুর্বলদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের, কারণ তাদের প্রার্থনা রিজিক বয়ে আনে।
নামাজকে ভুলবেন না, কারণ এটি মুমিন ও আল্লাহর মধ্যে এতখানি দূরত্ব কমায়, যতখানি কপাল ও জায়নামাজের মধ্যে দূরত্ব। সুন্নাহর ছোট ছোট অংশ পুনরুজ্জীবিত করুন, যা আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে। আমাদের ইচ্ছা, মহত্ত্বের আকাঙ্ক্ষা, অপচয়শীল সম্পদ, অবিরাম পার্টি ও ফ্যাশনের প্রতি আসক্তি নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া আমাদের এখন আর উপায় নেই।
সঠিক পথে আছি কি
দুনিয়া ও আখিরাত দুটি পরস্পরবিরোধী শত্রু ও ভিন্ন পথ। যে দুনিয়াকে ভালোবাসে এবং তার প্রতি ঝোঁকে, সে আখিরাতের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে এবং তার শত্রু হয়। এ দুটি পূর্ব ও পশ্চিমের মতো, যে যত একটির কাছে যায়, অন্যটি থেকে ততই দূরে সরে যায়। এরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। (নাহজুল বালাগা, হিকমত ১০৩)
আমাদের ভাবতে হবে, আমরা আল্লাহর পৃথিবীতে কী করছি? আমরা কি সত্যিকারের পথিকের মতো আচরণ করছি? আমরা কি আমাদের চারপাশের প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল, নাকি আল্লাহর স্মরণের পরিবর্তে শুধু নিজেদের স্মরণীয় করে রাখতে চাই? দুনিয়া সাময়িক, আখিরাত চিরস্থায়ী। আমরা এই দুনিয়ার জন্য কতটা কাজ করছি, আর আখিরাতের জন্য কতটা? এই দুনিয়া সীমিত, কিন্তু আমরা যা করি, অনুভব করি, বলি ও কাজ করি, তা আখিরাতে প্রতিফলিত হবে। মৃত্যুর পর সংশোধনের সুযোগ থাকবে না, কারণ সেই সুযোগ এখনই।
‘ডিসকভারিং ইসলাম’ আর্কাইভ থেকে