আলী ইবনে আবু তালিব পুরুষদের মধ্যে প্রথম মুসলমান

 পুরুষদের মধ্যে প্রথম আলী রাসুলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেন, তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন এবং তিনি যে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে ওহি পেতেন, তা বিশ্বাস করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র দশ বছর। অসীম ছিল তাঁর ওপর আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ, কারণ ইসলাম শুরু হওয়ার আগে থেকে রাসুলের হাতেই তিনি বড় হচ্ছিলেন।

মুজাহিদ ইবনে জাবির আবুল হাজাজের নাম ধরে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আবু নাজি আমাকে বলেছেন, আল্লাহ্‌ তাঁর ওপর করুণা এবং শুভেচ্ছা বর্ষণ করেছিলেন এমন এক সময়, যখন কোরাইশরা ছিলেন এক প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত। আবু তালিবের পরিবার অনেক বড়। রাসুলের (সা.) চাচা আল-আব্বাস বনু হাশিমদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিত্তশালী লোক। তাঁর কাছে গেলেন রাসুল (সা.)। বললেন, আবু তালিবের পরিবারে এত মানুষ, তাদের কিছুর দায়িত্ব তিনি যদি নেন, তাহলে ওরা বেঁচে যায়। আল আব্বাস রাজি হলেন। তারপর তিনি আবু তালিবের কাছে গিয়ে বললেন, তাঁর দুটি সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আল-আব্বাস নেবেন। তারপর দিন ফিরলে ছেলেদের তিনি আবার ফেরত নিয়ে আসতে পারবেন। আবু তালিব বললেন, ‘যা তোমাদের খুশি করো, কিন্তু আকিল আমার সঙ্গে থাকবে।’ রাসুল নিলেন আলীকে, তাঁকে রাখলেন নিজের সঙ্গে। আল-আব্বাস নিলেন জাফরকে।

আলী থেকে গেলেন রাসুলের (সা.) সঙ্গে নবুয়ত প্রাপ্তির কাল পর্যন্ত। আলী তাঁকে অনুসরণ করলেন, তাঁর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করলেন, তাঁর সত্য প্রচার করায় ব্রতী হলেন। আর জাফর থেকে গেলেন আল-আব্বাসের সঙ্গে। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে তাঁর কাছ থেকে চলে আসেন।

একজন হাদিস বর্ণনাকারী বলেছেন, নামাজের সময় হলেই রাসুল (সা.) চলে যেতেন মক্কার উপত্যকায়। সঙ্গে যেতেন আলী। আলী যে যেতেন তা তাঁর বাবা, চাচা কিংবা অন্য কোনো আত্মীয়স্বজন জানতেন না। সেখানে তাঁরা একসঙ্গে নামাজ পড়তেন, ফিরতেন রাতে। এমনি করে চলল আল্লাহ্‌রই হুকুমে। একদিন তাঁরা সেখানে নামাজ পড়ছিলেন, এমন সময় আবু তালিব এসে হাজির। তিনি রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওটা কী রকম ধর্মকর্ম করছ তোমরা, বৎস?’

রাসুল (সা.) উত্তর দিলেন, ‘এটি আল্লাহ্‌র ধর্ম, চাচা, আল্লাহ্‌র ধর্ম, তাঁর ফেরেশতার ধর্ম, তাঁর নবীদের ধর্ম, আমাদের বাবা ইব্রাহিমের ধর্ম।’

ঠিক এমনি ভাষায় নয় হয়তো। হয়তো তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ্‌ আমাকে মানুষের নবী করে পাঠিয়েছেন। আপনি আমার চাচা, সবচেয়ে শ্রদ্ধেয়জন, সবচেয়ে যোগ্য মানুষ। সত্যের পথে আনার জন্য, হেদায়ত করার জন্য আপনি সর্বোত্তম ব্যক্তি। আপনি ইচ্ছে করলেই আমার ডাকে সাড়া দিতে পারেন, আমাকে সাহায্য করতে পারেন।’

অথবা এমনি কিছু কথা।

তাঁর চাচা বললেন, ‘আমি আমার পিতা-পিতামহের ধর্ম ত্যাগ করতে পারি না। কিন্তু আমি যত দিন বেঁচে আছি, তত দিন কেউ তোমার কোনো অসুবিধা করতে পারবে না। প্রতিপালকের নামে শপথ করছি আমি।’

অনেকেই বলেন, তিনি নাকি আলীকে বলেছিলেন, ‘বাছা! এটা কী ধর্ম তোমার?’

আলী বলেছিলেন, আমি আল্লাহ্‌তে বিশ্বাস করি, রাসুলে বিশ্বাস করি, আমি বিশ্বাস করি, তিনি যা এনেছেন তা সত্য, আমি তাঁর সঙ্গে আল্লাহ্‌র কাছে নামাজ পড়ি, তাঁকে অনুসরণ করি।’

অনেকের মতে, জবাবে তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘ভালো ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে ও তোমাকে জড়াবে না। সুতরাং, ওর সঙ্গে লেগে থাকো।’

আলীর পর যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তিনি হলেন রাসুলের (সা.) মুক্তি পাওয়া দাস জায়েদ। তারপর মুসলমান হলেন আবু ইবনে আবু কুহাফা। তাঁর অন্য নাম ছিল আতিক। পিতা উসমান ইবনে আমির ইবনে আমর ইবনে কাব ইবনে সাদ ইবনে তায়ম ইবনে মুররা ইবনে কাব ইবনে লুয়ায়ি ইবনে গালিব ইবনে ফিহর। মুসলমান হওয়ার পর তিনি করলেন কি—এর মধ্যে আর রাখঢাক রাখলেন না, প্রকাশ্যে তাঁর বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করে বেড়াতে লাগলেন এবং যাকে পান তাকেই আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুলের (সা.) ওপর ইমান আনার জন্য আহ্বান জানাতে লাগলেন। তিনি ছিলেন উচ্চতর অভিজাত সমাজের লোক, বড় সুন্দর ভদ্র ছিল তাঁদের পরিবারের সবার আচরণ। ছোট-বড় সবাই তাঁদের পছন্দ করত। কোরাইশদের বংশবৃত্তান্ত আর প্রাচীন ইতিহাস তিনি যেমন জানতেন, অন্য কেউ তেমন জানত না। আবার তাঁদের দোষ-গুণের সংবাদও ছিল তাঁর নখদর্পণে। যেমন বিরাট বণিক, তেমনি বিরাট ছিল তাঁর হৃদয়, দয়া আর মায়াতে ভর্তি। সুবিধা-অসুবিধা, আপদে-বিপদে সবাই ছুটে আসত তাঁর কাছে পরামর্শের জন্য, কারণ তাঁর যেমন ছিল পর্যাপ্ত জ্ঞান, তেমনি ছিল ব্যবসায়ে বিশাল অভিজ্ঞতা আর সর্বোপরি এমন সুন্দর মিষ্টি মেজাজ। যাদের তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর কাছে আসত যারা, সবাইকে তিনি আল্লাহ্‌র পথে, ইসলামের পথে আসার জন্য আহ্বান জানালেন।

অনুবাদ: শহীদ আখন্দ

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে