ইসলাম মানুষের জীবনকে দুই বৃহৎ অধিকারের কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়েছে—আল্লাহর হক ও বান্দার হক। এই দুইয়ের সমন্বয় কীভাবে মানবজীবনকে ভারসাম্যপূর্ণ করে তোলে, তার গভীরতর দর্শনকে ব্যাখ্যা করার জন্য হাদিসের ভান্ডার আমাদের সামনে অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরে।
এর মধ্যে সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী ও শিক্ষণীয় একটি ঘটনা হলো বুখারি শরিফের ১৮৪২ নম্বর হাদিসে বর্ণিত সালমান ফারসি ও আবু দারদা (রা.)-র ঘটনা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ইসলামে অধিকার আদায়ের মূলনীতি—‘প্রত্যেক অধিকারীকে তার অধিকার দিয়ে দাও’-এর পূর্ণ ব্যাখ্যা ফুটে ওঠে।
সালমান ফারসি (রা.) সত্য অনুসন্ধানের দীর্ঘযাত্রা শেষে ইসলামের সান্নিধ্যে আসেন। আগমনের সময় তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃস্ব, এক ইহুদি ব্যক্তির গোলাম হিসেবে কাটাতে হয়েছে তাঁর দীর্ঘ জীবন।
যাঁর জন্য সাজবেন, ঘরটিকে সুন্দর রাখবেন—যদি তাঁরই আগ্রহ না থাকে, তবে তাঁর নিজের কি প্রয়োজন সাজগোজের কিংবা গৃহপরিচর্যার?
নবীজি মদিনায় আগমনের পর মুহাজির ও আনসারের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের যে বন্ধন গড়ে দেন, সেখানে সালমান ফারসির ভাই হিসেবে মনোনীত হন আবু দারদা। ইসলামের সামাজিক কাঠামোয় তখন এই ভ্রাতৃত্ব কেবল অনুভূতির বন্ধনই ছিল না, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক দায়িত্বেও এর প্রভাব ছিল। একে অপরকে নিজের মতোই বিবেচনা করার বিশেষ নির্দেশনা ছিল সেখানে।
নবনির্মিত এই ভ্রাতৃত্বের সূত্রে সালমান ফারসি যখন আবু দারদার ঘরে গেলেন, তখনই তিনি লক্ষ করলেন একটি অসামঞ্জস্য। ঘরের পরিবেশ ছিল অগোছালো, স্ত্রী উম্মে দারদা (রা.)-র পোশাক ছিল মলিন, নিজেকে পরিচর্যার সময় তিনি পাননি।
প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, স্বামী আবু দারদা দুনিয়াবি জীবনযাপন ও দাম্পত্য সম্পর্কের দায়িত্বগুলোকে প্রায় ভুলেই গেছেন; সারা দিন রোজা, সারা রাত ইবাদত—এই অবস্থা চলমান। যাঁর জন্য সাজবেন, ঘরটিকে সুন্দর রাখবেন—যদি তাঁরই আগ্রহ না থাকে, তবে তাঁর নিজের কি প্রয়োজন সাজগোজের কিংবা গৃহপরিচর্যার?
সালমান ফারসি অভিজ্ঞ চোখ বিষয়টিকে দ্রুতই অনুধাবন করল। স্বামী যদি স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি না দেন, তবে সে কেন নিজের সৌন্দর্যময় করে তুলবে? স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকারের যে সূক্ষ্ম সম্পর্ক ইসলামে নির্ধারিত, তা যেন আবু দারদার ব্যক্তিগত ইবাদতের চাপে চাপা পড়ে গেছে।
সমস্যার দ্বিতীয় প্রকাশ ঘটল মধ্যাহ্নভোজের সময়। সালমান ফারসির সামনে খাবার পরিবেশন করা হলেও আবু দারদা নিজে খেতে বসলেন না, কারণ, তিনি নফল রোজাদার।
সালমান (রা.) বললেন, ‘আমার সঙ্গে বসে খাও।’ আবু দারদা (রা.) অস্বীকৃতি জানালে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি না খেলে আমিও খাব না।’
মেহমানের সামনে এভাবে অবহেলা করা যাবে না, তাই বাধ্য হয়ে তিনি নফল রোজা ভাঙলেন। এখানে সালমান ফারসির অবস্থান ছিল অত্যন্ত সংযত ও গভীর জ্ঞানে উদ্দীপ্ত।
তোমার প্রতিপালকের তোমার ওপর যেমন হক আছে, তোমার শরীরেরও তোমার ওপর হক আছে; তোমার স্ত্রী ও পরিবারের তোমার ওপর হক আছে; তোমার মেহমানদেরও তোমার ওপর হক আছে, সুতরাং প্রত্যেককে তার হক দিয়ে দাও।সহিহ বুখারি, হাদিস; ১,৯৬৮
ফরজ ও ওয়াজিব নয়, নফল ইবাদতের ক্ষেত্রে মানুষের হক, বিশেষত মেহমানের অধিকার-অগ্রাধিকার পায়। পরে ইচ্ছা করলে তিনি এর কাজা আদায় করতে পারবেন। কিন্তু মেহমানের সম্মানকে উপেক্ষা করা ইসলামে অনুমোদিত নয়।
রাতেও একই ঘটনা ঘটল। আবু দারদা (রা.) সারা রাত নফল নামাজ পড়তে চান। সালমান (রা.) কঠোরভাবে তাঁকে আদেশ দিলেন, ঘুমাতে হবে। তিনি যখন কৌশলে সালমানকে ঘুমিয়ে আছে মনে করে আবার উঠতে গেলেন, তখনো সালমান তাঁকে থামালেন।
পরে তাহাজ্জুদের সময় এলে দুজনেই উঠলেন, নামাজ পড়লেন এবং ফজরের নামাজ আদায় করতে মসজিদে নববির দিকে রওনা হলেন।
এই যাত্রাপথেই সালমান ফারসি (রা.) বললেন, ইসলামের অধিকার-দর্শনের সারাংশ-তোমার প্রতিপালকের তোমার ওপর যেমন হক আছে, তোমার শরীরেরও তোমার ওপর হক আছে; তোমার স্ত্রী ও পরিবারের তোমার ওপর হক আছে; তোমার মেহমানদেরও তোমার ওপর হক আছে, সুতরাং প্রত্যেককে তার হক দিয়ে দাও। (সহিহ বুখারি, হাদিস; ১,৯৬৮)
সকালে ঘটনাটি রাসুলের কাছে বলা হলে তিনি বললেন, ‘সালমান সত্য বলেছেন।’ এর মাধ্যমে এ নীতি শুধু একটি উপদেশ নয়, বরং একটি শরিয়তসিদ্ধ নির্দেশে রূপ নিল।
এই ঘটনা ইসলামের আল্লাহর হক ও বান্দার হক—দুই ক্ষেত্রের দার্শনিক ভারসাম্যকে ফুটিয়ে তোলে। আল্লাহর অধিকার সর্বোচ্চ, কিন্তু তা কখনো মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের অনুমতি দেয় না।
ইসলামের দর্শন এমন নয় যে ইবাদতের নামে পরিবার, সমাজ, মেহমান, শরীর বা নিজের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করা যাবে। নফল ইবাদত তখনই মূল্যবান, যখন তা মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন না করে আদায় করা হয়।
ইবাদতের মধ্যে অতিরিক্ততা বা একপেশে মনোযোগ অনেক সময় অন্য অধিকারগুলোকে উপেক্ষিত করে দেয়। ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হলো সব অধিকারকে যথাস্থানে সমুন্নত রাখা।
দুনিয়ার ব্যস্ততায় যদি আল্লাহর হক বিস্মৃত হয়, তা–ও ইসলাম গ্রহণ করে না। ইসলামের সৌন্দর্য এখানেই যে এটি মানুষের জীবনের সব অধিকারকে একই সূত্রে গাঁথে।
এই নীতির আলোকে বোঝা যায় মানুষের অধিকার, পারিবারিক দায়িত্ব, সামাজিক কর্তব্য, নিজের শরীর ও স্বাস্থ্যের যত্ন, বিশ্রাম, খাদ্যগ্রহণ—এসবই ইসলামের অনুষঙ্গ। অধিকার বিবেচনায় ইসলাম একটি সমন্বিত জীবনযাত্রার আদর্শ নির্মাণ করে, যেখানে আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে সঠিক আচরণ করাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।
ব্যক্তিগত নফল আমল কখনোই অন্যের হক নষ্ট করার যুক্তি হতে পারে না। বরং হকের শ্রেণিবিন্যাসে নফলের ওপরে রয়েছে মেহমানের অধিকার, স্ত্রী-পরিবারের অধিকার, শরীরের অধিকার, মানুষের সঙ্গে সদাচরণ।
ঘটনাটি স্পষ্ট করে ইসলাম মানুষকে কেবল আধ্যাত্মিক বা ইবাদতমুখী জীবনে সীমাবদ্ধ রাখে না, বরং একটি পরিপূর্ণ মানবিক জীবনালোক দান করে। ব্যক্তিগত ইবাদত যদি সমাজ ও পরিবারের দায়িত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবে সেটি ইসলামের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয় নয়।
তেমনি দুনিয়ার ব্যস্ততায় যদি আল্লাহর হক বিস্মৃত হয়, তা–ও ইসলাম গ্রহণ করে না। ইসলামের সৌন্দর্য এখানেই যে এটি মানুষের জীবনের সব অধিকারকে একই সূত্রে গাঁথে এবং ভারসাম্যের সূক্ষ্মতম রূপটি তুলে ধরে।
আহমাদ সাব্বির : আলেম ও লেখক