করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আমাদের ওমরাহ সফর বাতিল হয়ে গিয়েছিল একেবারে শেষ মুহূর্তে। আর মহামারি ছড়িয়ে পড়ায় সে বছর মানে ২০২০ সালে গুটিকয়েক হাজির উপস্থিতিতে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে হজ পালিত হতে দেখে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে? কবে ওমরাহ করতে যেতে পারব? আদৌ যেতে পারব কি? এমন সব প্রশ্ন ঘুরে ঘুরে মনে আসছিল। তবে কয়েক মাস পরে পরিস্থিতি খুব ধীরে ধীরে উন্নতি হতে শুরু করল। তখনই আমরা নিয়ত করে ফেললাম যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলে প্রথম সুযোগেই হজ করব। আর তাই আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতিও শুরু করে দেই।
কিন্তু সরকারি না বেসরকারিভাবে হজে যাব? খোঁজখবর নিতে শুরু করি। সহধর্মিণীর পরামর্শে প্রথম আলোর হজ প্রতিনিধি ফেরদৌস ফয়সালের সঙ্গে আলাপ করি। ও আমাদের প্রথমেই প্রাক-নিবন্ধন করে ফেলতে বলে এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায়। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনার সুযোগ-সুবিধাগুলো সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ধারণাও দেয়। এর আগ পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ সম্পর্কে নেতিবাচক কথাই বেশি শুনেছি। তা ছাড়া, সত্যি কথা বলতে, হজের বিষয়ে আমার আগ্রহটা আগের খুব জোরালো না থাকায় এ নিয়ে যথেষ্ট খোঁজখবর করার তাগিদও অনুভব করিনি। যদিও প্রতিবছরই আপনজন ও পরিচিতিজনদের মধ্যে অনেকেই হজে গিয়েছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা বিচ্ছিন্নভাবে জেনেছি। তবে ছোটবেলায় আমার দাদি হজ করে আসার পর তাঁর কাছ থেকে প্রথম হজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। সেটা ছিল ১৯৭০-এর দশকের শেষদিকের কথা।
সে যাই হোক, সরকারি ব্যবস্থাপনায় গেলে মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় ট্রেনে করে যাতায়াতের সুবিধা মিলবে এটা জানতে পারায় আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিছুটা সহজ হয়ে যায়। আমরা ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ২০২১ সালের অক্টোবরে ইসলামী ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে প্রাক-নিবন্ধন করে ফেলি অনলাইনে-আমার আম্মার, আমার সহধর্মিণীর এবং আমার নিজের। এর মধ্য দিয়ে আসলে ক্রমিক নম্বর নেওয়া হলো। সেই ক্রমানুসারে হজের নিবন্ধন করার জন্য ডাক আসবে। বাংলাদেশ সরকার এই প্রাক-নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে হজ ব্যবস্থাপনাকে একটি শৃঙ্খলার জায়গায় নিয়ে আসে। সরকারি বা বেসরকারি যেভাবেই কেউ হজে যান না কেন, আগে এই প্রাক-নিবন্ধন করতে হবে। প্রাক-নিবন্ধন করার পর প্রত্যেকের জন্য একটি স্বতন্ত্র ট্র্যাকিং নম্বর দেওয়া হয় যা ওই ব্যক্তির হজের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করার জন্য ব্যবহৃত হয়। আর প্রাক-নিবন্ধনের সময় যে মোবাইল ফোন নম্বর দিতে হয়, ওটাতেই হজের যাবতীয় খুদে বার্তা আসে।
২০২১ সালে কোভিড মহামারির কারণে শুধু সৌদি আরবে বসবাসকারী ৬০ হাজার হাজিকে হজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য করোনা ভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরু করাসহ মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করলে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সৌদি আরব ওমরাহর ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করতে শুরু করে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা তিনজন ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ওমরাহ পালন করি। আর তাতে করে হজ করার ইচ্ছেটা প্রবলতর হয়ে ওঠে। সেসময় মক্কা ও মদিনায় সফর করে এবং সহযাত্রীদের মধ্যে যারা হজ করেছেন, তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শুনে এও বুঝতে পারি যে নিজে হজ না করা পর্যন্ত এর যে অসাধারণ অনুভূতি ও অনন্য অভিজ্ঞতা তা কখনোই উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না।
২০২২ সালে এই মহামারি পরবর্তী প্রথম হজে বিভিন্ন দেশ থেকে সীমিত সংখ্যক হাজি নেওয়ার কথা জানায় সৌদি সরকার। তাতে বাংলাদেশ থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চার হাজার ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সাড়ে ৫৩ হাজার মানুষকে হজে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। আমরা প্রাক-নিবন্ধনের পর থেকেই আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলাম যে আসন্ন মৌসুমেই হজ আদায় করতে পারি। কিন্তু সীমিত কোটার কারণে আমাদের ডাক আসেনি। তবে প্রাক-নিবন্ধন অনুসারে ওয়েবসাইটে আমাদের ক্রমাবস্থান দেখে আমি নিশ্চিত হয়ে যাই যে পরের বার আল্লাহর হুকুমে আমার অবশ্যই হজে যেতে পারব। সেই প্রত্যাশায় দোয়াও করতে থাকি নিয়মিত। পাশাপাশি হজ বিষয় বইপত্র ও অনলাইনে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখা পড়তে থাকি, ইউটিউবে হজের বিভিন্ন ভিডিও দেখতে থাকি, আর পত্রপত্রিকা থেকে নিয়মিত হজের খবর জানতে থাকি। পরিচিতজন যাঁরা হজ করেছেন, তাঁদের কাছ থেকে আমি ও আমার সহধর্মিণী বিস্তারিতভাবে হজের অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করতে থাকি।
এর মধ্যে আরেকটি বড় ও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ওমরাহ সফরের শেষ দিক আম্মা পায়ের ব্যথায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। ঠিকমতো হাঁটতেও পারছিলেন না। হুইল চেয়ারে করে তাঁকে দেশে ফিরতে হয়েছিল। এরপর চিকিৎসা করে অবস্থার উন্নতি হয় বটে, কিন্তু আরও কিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। হজ যেহেতু একাধারে কষ্টসাধ্য শারীরিক পরিশ্রম ও মানসিক দৃঢ়তার ইবাদতও বটে, তাই শারীরিক ও মানসিকভাবে যথেষ্ট সক্ষম হওয়া জরুরি। আমি ও আমার ছোট বোন আম্মার সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি। আম্মাও একমত হন যে তিনি এতটা পরিশ্রমের ধকল নিতে পারবেন না। ফলে আম্মাকে বাদ রেখেই আমাদের হজে যাওয়ার প্রস্তুতি এগোতে থাকে। আর এটাকে আমরা বেদনাবিধুর চিত্তে আল্লাহর ফয়সালা বলে মেনে নেই।
আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক।