খ্রিষ্টানদের সঙ্গে মহানবীর (সা.) শান্তিচুক্তি
ইসলামের আবির্ভাবের সময় যারা এই নতুন ধর্মের বিরোধিতা করেছে, তাদের অধিকাংশ নিজেদের স্বার্থ এবং প্রভাব হারানোর ভয়ে ইসলামকে বিপদ মনে করেছিল। অধিকাংশ মানুষের অবস্থান ছিল নিরপেক্ষ, তারা ‘দেখি কী হয়’ ধরনের মনোভাব পোষণ করেছিল। ইসলামের আগমনের পূর্বে, আরবের সব উপজাতির মধ্যে কুরাইশ ছিল সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ ও শক্তিশালী। তারপর কুরাইশ গোত্রীয়রা ইসলাম এবং নবীজির (সা.) বিরোধিতায় অবতীর্ণ হওয়ার পর বাকি সব আরবি উপজাতি হয়তো কুরাইশের অনুসরণ করে।
নাজরানের কূটনৈতিক মিশন
নবী মুহাম্মদ (সা.) তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর, তিনি তার নিকটতম সঙ্গী আবু বকরকে হজ পরিচালনার জন্য এবং তার চাচাতো ভাই আলীকে মক্কায় ইসলামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য পাঠান, যাতে মক্কায় কেউ পুরনো জাহেলিয়াতের রীতি অনুযায়ী হজ পালন করতে না পারে। তখনই সমস্ত আরব উপজাতির কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলামি রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতা আর কারও নেই। এর পর তারা তাদের অবস্থান পর্যালোচনা করতে শুরু করে।
বিভিন্ন উপজাতির প্রতিনিধিরা মদিনায় আসে, কেউ ইসলামের মৌলিক দিক জানার জন্য, আবার কেউ তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য। তাদের মধ্যে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদল এসেছিল নাজরান থেকে।
নাজরান, যা তখন আরবের দক্ষিণে একটি খ্রিষ্টান উপত্যকা, সেখানে আবু হারিতাহ ইবন আল্কামা নামে একজন বিশপ ছিলেন যিনি বাইজেন্টাইন সম্রাটদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং সেখানে বেশ কিছু চার্চ নির্মাণে সহায়তা করেছিলেন।
নবী মুহাম্মদ (সা.) তাদের ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে একটি পত্র পাঠান এবং তার প্রতি উত্তরে নাজরান থেকে ৬০ জনের একটি প্রতিনিধিদল মদিনায় আসে। মদিনায় এসে তারা নবীজির সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। তাদের সান্ধ্যকালীন প্রার্থনার সময় হয়ে এলে তবে নবীজি (সা.) তাঁর সাহাবিদের নির্দেশ দেন, তারা যেন নাজরানীদের প্রার্থনা করতে দেয়।
শান্তিচুক্তি
নাজরানীরা নবীজিকে (সা.)-এর কাছে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি ঈসাকে (আ.) কীভাবে দেখেন? আমরা খ্রিষ্টান, আমাদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।’ নবীজি বললেন, ‘আজ আপনাদের জন্য কিছু বলব না, কাল জানাতে পারব, ইনশাআল্লাহ।’
পরদিন, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি লাভ করেন, যেখানে বলা হয়, ঈসাকে (আ.) আদমের মতোই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে আল্লাহ কর্তৃক দেওয়া ‘হও’ বলার মাধ্যমে অস্তিত্বে আনা হয়। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৫৯-৬১)।
নবীজি (সা.) নাজরানীদেরকে নতুন এই তথ্য জানালে তারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর নবীজি তাদের একটি চ্যালেঞ্জ দেন—যা কোরআনেও উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ, যারা সত্য তারা ছাড়া অন্য দলটি যেন ধ্বংস হয়ে যায়, উভয় পক্ষ একটি স্থানে দাঁড়িয়ে সেই প্রার্থনা করবে। এটা ছিল তাদের জন্য এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ, কারণ এর মাধ্যমে তাদের আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
পরের দিন, শুরাহবিল নামের একজন প্রতিনিধি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে শান্তি চুক্তি করার প্রস্তাব দেন। তিনি একদিনের মধ্যে শর্তাবলি জানাতে বলেন এবং তারা যেকোনো শর্ত মেনে নেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
চুক্তির শর্তাবলি
মহানবীর (সা.) সঙ্গে তাদের শান্তি চুক্তির শর্তাবলি ছিল এমন:
১. আল্লাহর রাসুল হিসেবে নাজরানবাসীর ওপর নবীজির (সা.) কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
২. প্রতি বছর তারা ২,০০০ হুল্লা প্রদান করবে—১,০০০ রজব মাসে এবং ১,০০০ সফর মাসে। প্রতিটি হুল্লা একটি আউন্সের সমান, যা ৪ দিরহাম সমান।
৩. নবীজির (সা.) বার্তাবাহকদের তারা ২০ দিনের জন্য থাকার ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় খরচের ব্যবস্থা করবে। তবে কোনো বার্তাবাহক নাজরানে এক মাসের বেশি থাকবে না। তাদের ৩০টি ঢাল, ৩০টি ঘোড়া এবং ৩০টি উট ঋণ হিসেবে দিতে হবে, যাতে ইয়েমেনে কোনো বিশৃঙ্খলা বা বিশ্বাসঘাতকতা ঘটলে তা কাজে লাগানো যায়। যদি এই ঢাল, ঘোড়া বা উট কিছু হারিয়ে যায়, তবে তা নবীজির (সা.) বার্তাবাহকের দায়ে থাকবে, যতক্ষণ না তা ফেরত দেওয়া হয়।
৪. আল্লাহ ও মুহাম্মদ (সা.)-এর পক্ষে নাজরানবাসীদের জীবন, ধর্ম, জমি, সম্পত্তি, উপস্থিত ও অনুপস্থিত সদস্যদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হলো। তাদের কোনো পুরোনো রীতি পরিবর্তন করতে হবে না। তাদের ধর্মীয় অধিকার বা বিশ্বাসে কোনো পরিবর্তন আনা হবে না।
৫. তাদের পুরোহিত, যাজক বা চার্চ রক্ষককে তার পদ থেকে সরানো হবে না।
৬. যতটুকু কিছু তাদের আছে, তা তাদেরই থাকবে, বড় হোক বা ছোট। তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হবে না এবং তারা কোনো প্রতিশোধমূলক হত্যার শিকার হবে না। তাদেরকে বাহিনী গঠন করতে বাধ্য করা হবে না এবং কোনো সেনাবাহিনী তাদের ভূমিতে প্রবেশ করতে পারবে না।
৭. যদি তাদের কেউ তার কোনো অধিকার দাবি করে, তবে তার জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। যে ব্যক্তি পূর্ববর্তী ঋণের ওপর সুদ নেয়, সে এই সুরক্ষার আওতায় থাকবে না। নাজরানে কোনো ব্যক্তি অন্যের করা অন্যায়ের জন্য দায়ী হবে না।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩,১২০)
সূত্র: অ্যাবাউট ইসলাম ডট কম