ফিলিস্তিন ও ইসলাম: অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ৫ দিক

ফিলিস্তিন নামটি শুধু ভূখণ্ডের সীমানায় আবদ্ধ নয়; বরং ইসলামের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এ পবিত্র ভূমি মুসলিমদের হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে, যেখানে নবী-রাসুলদের পদচিহ্ন, কোরআনের উল্লেখ এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলি এক অপূর্ব সংযোগ সৃষ্টি করেছে। ইসলামের সঙ্গে ফিলিস্তিনের এ অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের পাঁচটি দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক।

১. নবীদের ঐতিহ্য ও ফিলিস্তিন

ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসলামের অনেক নবী-রাসুলের জীবন ও কর্মের ছাপ রয়েছে। হজরত ইব্রাহিম, ইসহাক, সোলায়মান ও ঈসা (আ.)—তাঁদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এ ভূমিতে কেটেছে। ইয়াকুব (আ.)-এর সমাধিও আছে এ পবিত্র ভূমিতে। বিশেষ করে মুসা (আ.)-এর কাহিনি ফিলিস্তিনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

হে আমার কওম, তোমরা সেই পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করো, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন।
সুরা মায়িদা, আয়াত: ২১

তিনি ফেরাউনের অত্যাচার থেকে বনি ইসরাইলকে মুক্ত করে ফিলিস্তিনে নিয়ে আসেন। কোরআনে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, ‘হে আমার কওম, তোমরা সেই পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করো, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ২১)

নবীদের এ ঐতিহ্য ফিলিস্তিনকে মুসলিমদের কাছে একটি আধ্যাত্মিক কেন্দ্রে পরিণত করেছে। এ ভূমি শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, মুসলিমদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতেও গভীরভাবে প্রোথিত।

আরও পড়ুন

২. ইসলামের প্রথম কিবলা: মসজিদুল আকসা

ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা ইসলামের প্রথম কিবলা। নবুওয়াতের প্রথম দিকে মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা জেরুজালেমের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করতেন। এ প্রথা প্রায় ১৬ মাস ধরে চলেছে, যতক্ষণ না আল্লাহ তায়ালা কাবার দিকে মুখ ফেরাবার আদেশ দেন।

কোরআনে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, ‘আমি দেখছি, তুমি বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছ। অতএব আমি তোমাকে এমন কিবলার দিকে ফিরিয়ে দেব, যা তুমি পছন্দ করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৪৪)

মসজিদুল আকসার এ ঐতিহাসিক তাৎপর্য মুসলিমদের কাছে এ ভূমিকে আরও মহিমা দিয়েছে। এতেই এ কেবল একটি মসজিদ নয়; বরং ইসলামের ইতিহাসের একটি জীবন্ত স্মারক।

৩. অলৌকিক ঘটনার কেন্দ্রস্থল

প্রবাদ আছে, ফিলিস্তিন থেকে বেহেশত সবচেয়ে কাছে। কারণ, এখান থেকেই নবীজির আল্লাহর সাক্ষাতে আকাশের পথে যাত্রা শুরু করেন। তাই ফিলিস্তিনের ধর্মীয় গুরুত্বের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো মুহাম্মদ (সা.)-এর সেই নৈশযাত্রা ও মিরাজের ঘটনা। এ অলৌকিক রাতের সফরে তিনি মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যান।

সেখানে তিনি দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন এবং পরে আল্লাহ তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নেন। কোরআনে এ ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে, ‘পবিত্র তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাত্রিবেলা সফর করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায়, যার চারপাশ আমি বরকতময় করেছি।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ১)

এ ঘটনা ফিলিস্তিনকে মুসলিমদের কাছে একটি অলৌকিক স্থান হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছে।

আরও পড়ুন

৪. ‘পবিত্র’ ও ‘বরকতময়’ ভূমি

কোরআনে ফিলিস্তিনকে ‘পবিত্র ভূমি’ ও ‘বরকতময় ভূমি’ হিসেবে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা মায়িদায় (আয়াত: ২১) মুসা (আ.)-এর কওমকে ফিলিস্তিনে প্রবেশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সুরা ইউনুসে (আয়াত: ৯৩) সোলায়মান (আ.)-এর শাসনকালের উল্লেখে জেরুজালেমকে বরকতময় ভূমি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ আয়াতগুলো ফিলিস্তিনকে মুসলিমদের কাছে একটি পবিত্র কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

৫. হজরত ঈসা (আ.) ও ইমাম মাহদি

ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, ফিলিস্তিন শেষ জমানায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। হাদিসে উল্লেখ আছে, ইমাম মাহদি পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আবির্ভূত হবেন এবং ফিলিস্তিনে ‘সুফিয়ানি’ নামের অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য বিজয় হবে। এ ছাড়া ঈসা (আ.) আবার অবতরণ করবেন, ফিলিস্তিনে যাবেন এবং ইমাম মাহদির সঙ্গে নামাজ আদায় করবেন। মুসলিম শরিফে রয়েছে, ‘ঈসা ইবনে মরিয়ম পূর্ব দিকে দামেস্কের সাদা মিনারে অবতরণ করবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৯৩৭)

ফিলিস্তিন শেষ জমানায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ইমাম মাহদি পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আবির্ভূত হবেন এবং ফিলিস্তিনে ‘সুফিয়ানি’ নামের অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য বিজয় হবে।

বোঝা যায় ফিলিস্তিন কেবল অতীতের ইতিহাস নয়; বরং মুসলিমদের জন্য ভবিষ্যতের আশার প্রতীকও বটে।

মোটকথা, ফিলিস্তিন কেবল একটি ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি ইসলামের ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা ও ভবিষ্যৎ আশার একটি প্রতীক। নবী-রাসুলদের ঐতিহ্য, মসজিদুল আকসার পবিত্রতা, অলৌকিক ঘটনা, কোরআনের উল্লেখ এবং শেষ জমানার ভবিষ্যদ্বাণী—এই সবকিছুই ফিলিস্তিনকে মুসলিমদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। এ ভূমির প্রতি মুসলিমদের ভালোবাসা কেবল ধর্মীয় নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন, যা সময়ের সঙ্গে আরও গভীর হয়েছে।

আরও পড়ুন