একটি খুন ও গাভি নিয়ে বনি ইসরাইলের বাড়াবাড়ি

একটি খুন ও গাভি নিয়ে বনি ইসরাইলের বাড়াবাড়ি

আজ প্রথম তারাবিহ। খতমে তারাবিহতে কোরআনুল কারিমের প্রথম দেড় পারা তিলাওয়াত করা হবে আজ; সুরা ফাতিহা ও সুরা বাকারার ১ থেকে ২০৩ নম্বর আয়াত পড়া পর্যন্ত।

ইসলামের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিধানের আলোচনা রয়েছে এই অংশে। কোরআনের বৈশিষ্ট্য, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসীদের এবং কপটদের পরিচয়, পৃথিবীতে মানুষের আগমন, ফেরেশতাদের সিজদা, ইবলিশের সিজদায় অস্বীকৃতি ও অহংকার, ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানি, কাবাঘর নির্মাণ, মহানবী (সা.)-এর যুগে কিবলা পরিবর্তনের কারণ ও যৌক্তিকতা, হালাল-হারামের নীতিমালা, অবৈধ পন্থায় সম্পদ উপার্জন, হত্যার অপরাধে হত্যা ও ক্ষমার বিধান, রমজানের রোজা, হজ, খুন, বনি ইসরাইলের বাড়াবাড়ি, চান্দ্র তারিখ ব্যবহারের প্রতি উৎসাহসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবৃত হয়েছে।

কোরআনের নির্যাস সুরা ফাতিহা

সুরা ফাতিহা কোরআনের প্রথম সুরা। নবীজি (সা.)-এর ওপর নাজিলকৃত প্রথম পূর্ণাঙ্গ সুরাও এটি। মোট দুবার এই সুরা নাজিল হয়েছে; একবার মক্কায় ও আরেকবার মদিনায়। নামাজে এ সুরা পড়া আবশ্যক। সাত আয়াতের ছোট্ট এ সুরায় ফুটে উঠেছে কোরআনের সারসংক্ষেপ। এ সুরায় সমগ্র কোরআনের সার নির্যাস সংক্ষিপ্তাকারে বলে দেওয়া হয়েছে। কোরআনের অন্য সুরাগুলো প্রকারান্তরে সুরা ফাতিহারই বিস্তৃত ব্যাখ্যা। এ সুরাকে ‘কোরআনে মা’ ও ‘কোরআনের সার’ বলা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এটাই উম্মুল কোরআন, এটাই সাবআ মাসানি এবং এটাই কোরআনুল আজিম।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস: ২,৮৭৫)

সুরা ফাতিহার প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা এবং শেষের তিনটি আয়াতে মানুষের পক্ষ থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও দরখাস্তের বিষয়বস্তুর সংমিশ্রণ। মাঝের একটি আয়াত প্রশংসা ও দোয়া মিশ্রিত। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, পৃষ্ঠা: ২)

আরও পড়ুন

সুরা ফাতিহা রোগের ওষুধ

রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেওয়া আল্লাহর উপহারের অন্যতম সুরা ফাতিহা। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে মহানবীর জন্য বিশেষ নুর যা অন্য কোনো নবী-রাসুলকে দেওয়া হয়নি। (মুসলিম, হাদিস: ১,৭৫০) শরিয়তসম্মত রুকইয়ার ক্ষেত্রে সুরা ফাতিহার উপকারিতা শীর্ষে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সুরা ফাতিহা মৃত্যু ছাড়া সব রোগের মহৌষধ।’ (শুয়াবুল ইমান, বাইহাকি, হাদিস: ২,৩৭০)

গাভির নামে কোরআনের দীর্ঘতম সুরা

মদিনায় অবতীর্ণ সুরা বাকারার আয়াত সংখ্যা ২৮৬টি। কোরআনের দীর্ঘতম সুরা এটি। বাকারা অর্থ গাভি। এ সুরায় একাধিক স্থানে বাকারা শব্দ এসেছে এবং গাভি জবাইয়ের ঘটনা রয়েছে, এ জন্য এর নাম রাখা হয়েছে সুরা বাকারা। ইসলামের মৌলিক নীতি, বিশ্বাস ও শরিয়তের বিধিবিধানের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এ সুরায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক জিনিসের একটি চূড়া বা শিখর থাকে। আর কোরআনের শিখর হচ্ছে সুরা বাকারা।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২,৮৭৮)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের ঘরগুলো কবর বানিয়ো না। নিশ্চয় যে ঘরে সুরা বাকারা তিলাওয়াত করা হয়, শয়তান সে ঘরে প্রবেশ করতে পারে না।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২,৮৭৭) এ সুরায় এক হাজার আদেশ, এক হাজার নিষেধ, এক হাজার হেকমত এবং এক হাজার সংবাদ ও কাহিনি রয়েছে। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, পৃষ্ঠা: ১১)

কোরআনের বিচ্ছিন্ন অক্ষরমালা

সুরা বাকারার প্রথম অক্ষরগুলো ‘আলিফ, লাম, মিম’। এগুলোকে হুরুফে মুকাত্তায়াত (রহস্যময় অক্ষরমালা) বলা হয়। কোরআনের আরও কয়েকটি সুরার শুরুতে এ রকম হরফ রয়েছে। অধিকাংশ সাহাবি, তাবেয়ি এবং আলেমদের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত মত হলো, হুরুফে মুকাত্তায়াতগুলো রহস্যপূর্ণ, যার মর্ম ও মাহাত্ম্য একমাত্র আল্লাহ তাআলা জানেন। অন্য কাউকে এ বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া হয়নি। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খ: ১, পৃষ্ঠা: ১৭৮-১৭৯)

আরও পড়ুন

 মুত্তাকির পাঁচ গুণ

মুত্তাকি মানে আল্লাহভীরু। যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে এবং যারা আল্লাহর ভয়ের কারণে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। ৩ ও ৪ নম্বর আয়াতে মুত্তাকিদের পাঁচটি গুণের কথা বলা আছে। ক. ওই সমস্ত বাস্তব সত্য বিষয়ের ওপর ইমান আনা, যেগুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়।

যেমন জান্নাত, জাহান্নাম, হাশর ইত্যাদি। খ. নামাজ কায়েম করা। গ. জাকাত দেওয়া। ঘ. ওই সমস্ত আসমানি কিতাবের ওপর বিশ্বাস রাখা, যেগুলো যুগে যুগে বিভিন্ন নবী-রাসুলের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। ঙ. পরকাল বিশ্বাস করা।

কপটের ১২ চিহ্ন

মুনাফেক বা কপটের ১২টি চিহ্ন বা আলামতের বিবরণ এ সুরার ৮ থেকে ২০ নম্বর আয়াতে রয়েছে। যেমন: এক. মিথ্যা বলা। দুই. ধোঁকা দেওয়া। তিন. অন্তরে কপটতা ও বক্রতা রয়েছে। চার. সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে নিজেকে শান্তিকামী দাবি করা। পাঁচ. নির্বুদ্ধিতা। ছয়. আল্লাহ-প্রদত্ত বিধিবিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা। সাত. ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা। আট. বিশ্বাসীদের বন্ধু দাবি করলেও অবিশ্বাসীদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করা। নয়. মূর্খতা। দশ. গোমরাহি ও ভ্রষ্টতা। এগারো. হেদায়তের মর্ম বুঝতে না পারা। বারো. ইমানদারদের নিয়ে উপহাস করা।

অনন্য কোরআন

এই সুরার ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা আরবি ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকদের কোরআনের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। কেউ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেনি। তাঁরা একটি সুরা; এমনকি একটি আয়াতও রচনা করতে পারেনি। কারণ, কোরআনের রয়েছে বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য। যথা: ১. কোরআন একটি গতিশীল ও কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী মুজেজা বা অলৌকিক। ২. এটি বিশ্ববাসীর জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। ৩. কোরআনে বর্ণিত সব কথা, ভবিষ্যদ্বাণী সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। ৪. এ গ্রন্থে পূর্ববর্তী উম্মত, তাদের শরিয়ত, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঘটনা এবং জীবনধারণ সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে। ৫. কোরআন শুনলে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসীদের ওপর প্রভাব পড়ে। ৬. এ গ্রন্থ বারবার পাঠ করলেও মনে বিরক্তি আসে না। ৭. এটি সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহর। ৮. এতে আছে ইলম ও জ্ঞানের ভান্ডার।

আরও পড়ুন

বনি ইসরাইল নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা

আল্লাহ তাআলা কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় নানা প্রসঙ্গে বনি ইসরাইলের আলোচনা করেছেন। এ সুরার প্রথম পারার বেশির ভাগ অংশজুড়ে আছে তাদের ওপর আল্লাহ অনুগ্রহ, তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি নবী-রাসুল প্রেরণ, ফেরাউনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি দান, খাবার হিসেবে মান্না ও সালওয়া, ছায়া হিসেবে শীতল মেঘমালা প্রদান এবং পানির প্রয়োজন মেটাতে পাথরের বুক চিরে ১২টি নদীর প্রকাশ, ফেরাউনকে তার বাহিনীসমেত সমুদ্রে নিমজ্জিত এবং বনি ইসরাইলদের সত্যকে গোপন ও অকৃজ্ঞতার বর্ণনা। একটি খুন ও গাভি নিয়ে বনি ইসরাইলের বাড়াবাড়ি, বনি ইসরায়েলের এক ধনী লোক, তার সন্তান ছিল না। তার উত্তরাধিকারী ছিল এক ভ্রাতুষ্পুত্র। সম্পত্তির লোভে সে চাচাকে হত্যা করে বসে। রাতে গ্রামের এক লোকের দরজায় মরদেহ রেখে আসে এবং সকালে ওই লোকের ওপর হত্যার অপবাদ দেয়। দুই দলের মধ্যে বিবাদ বেঁধে যায়। মুসা (আ.)-এর কাছে বিচার আসে। আল্লাহর নির্দেশে মুসা (আ.) তাদের একটি গাভি জবাই করে হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটনের আদেশ দেন। তারা ব্যাপারটাকে ঠাট্টা মনে করল। মুসা (আ.) তাদের সতর্ক করলেন। তারা নবীর কথা মেনে নিল। গাভির রং কেমন হবে জানতে চাইল। অথচ আল্লাহর প্রথম নির্দেশে গরুর কোনো নির্দিষ্ট রঙের কথা উল্লেখ ছিল না। তাদের বাড়াবাড়িতে মুসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশে রঙের কথা বলে দিলেন। তারপর তারা গরুর ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে চাইল। মুসা (আ.) তা-ও বলে দিলেন। তারা আল্লাহ বিশ্বাসী ও মা ভক্ত এক যুবকের কাছে বর্ণনাকৃত গাভিটি পেল। যুবকের চাহিদা মতো গরুর চামড়াপূর্ণ স্বর্ণের দামে তারা কিনল। তারা গাভিটি জবাই করল। আল্লাহর নির্দেশ মতো মাংসের একটি অংশ খুন হওয়া মানুষটির দেহে স্পর্শ করলে মৃত মানুষটি জীবিত হয়ে যে মানুষটি বিচার নিয়ে গিয়েছিল, তার নাম বলে দেয়। (সুরা বাকারা, আয়াত: ৭২)

কিছু সৎকাজ ও সত্যাশ্রয়ী যারা

এ সুরার ১৭৭ নম্বর আয়াতে কয়েকটি সৎকাজ ও সত্যাশ্রয়ী পরহেজগার মানুষের বৈশিষ্ট্যের বিবরণ রয়েছে। সৎকাজ হলো আল্লাহ, কিয়ামত দিবস, ফেরেশতা ও সমস্ত নবী-রাসুলদের প্রতি ইমান আনা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম-মিসকিন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসের জন্য সম্পদ ব্যয় করা। সত্যাশ্রয়ী পরহেজগার ব্যক্তি হলেন, নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী, জাকাত আদায়কারী, ওয়াদা পালনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যশীল। অবৈধ পন্থায় সম্পদ উপার্জন মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ অর্থসম্পদ। বৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন করা ইবাদত। এটি ইবাদত কবুলের শর্তও। চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা, দালালি, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা, চোরাকারবারি প্রভৃতি পন্থায় সম্পদ অর্জন হারাম। এ সুরার ১৮৮ নম্বর আয়াতে অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভোগ করতে নিষেধ করা হয়েছে।

 আবু আশফাক মুহাম্মাদ: লেখক ও আলেম

আরও পড়ুন