কোরআনের সৌন্দর্য উপভোগ করবেন কীভাবে 

কোরআন মজিদ এমন একটি গ্রন্থ, যা শুধু ধর্মীয় নির্দেশনার উৎসই নয়, বরং এর ভাষা, শৈলী ও শৈল্পিক সৌন্দর্য মানুষের হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে। কোরআন আরবদের মনে এমন প্রভাব ফেলেছিল যে, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সকলেই এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিল। ওয়ালিদ ইবনে মুগিরার মতো অবিশ্বাসী এর প্রভাবে বিচলিত হয়েছিলেন, উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) তাৎক্ষণিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

কোরআনের সৌন্দর্য কেবল এর নির্দেশনা, অদৃশ্যের খবর বা জ্ঞানে সীমাবদ্ধ নয়। সাহাবারা এর তাফসির নিয়ে বেশি চিন্তিত না হয়ে এর ওপর আমল করতে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাবেয়িদের সময়ে তাফসিরের প্রসার ঘটে, তবে তা মূলত ভাষাগত অর্থ ব্যাখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

পরবর্তী সময়ে ফিকহ, বিতর্ক, ব্যাকরণ, ইতিহাস ও কিংবদন্তির বিষয়গুলো তাফসিরে প্রাধান্য পায়, কিন্তু কোরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্যের দিকটি প্রায় উপেক্ষিত থেকে যায়। পরবর্তী যুগে এই উপেক্ষা আরও বেড়ে যায়। কয়েকটি বিষয় আমরা তুলে ধরছি।

কাফিরদের কাজের নিষ্ফলতা বোঝাতে বলে, “যারা তাদের প্রতিপালককে অবিশ্বাস করেছে, তাদের কাজের উপমা হলো ঝড়ো দিনে বাতাসে উড়ে যাওয়া ছাইয়ের মতো।”

কোরআনের শৈল্পিক চিত্রায়ণ

কোরআনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর ঐক্যবদ্ধ শৈল্পিক শৈলী—তা সুসংবাদ, সতর্কবাণী, অতীতের গল্প, ভবিষ্যতের ঘটনা, দুনিয়ার জীবন বা আখিরাতের বর্ণনা যাই হোক না কেন। এটি বিমূর্ত ধারণাগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যে, তা পাঠকের সামনে জীবন্ত ছবির মতো ফুটে ওঠে। শরিয়ার আইন ব্যতীত কোরআনের প্রায় প্রতিটি অংশে এই চিত্রায়ণ দেখা যায়।

যেমন, কোরআন যখন কাফিরদের আল্লাহর কাছে অগ্রহণযোগ্যতার কথা বলতে চায়, তখন সরাসরি বলে না। বরং বলে, “যারা আমার আয়াতে অবিশ্বাস করে এবং অহংকার করে, তাদের জন্য আসমানের দরজা খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না উট সুঁইয়ের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে।” (সুরা আরাফ, আয়াত: ৪০)

এখানে ‘উট’ বলতে মোটা দড়ি বোঝানো হয়েছে। এই চিত্র মানুষের মনে এমন একটি দৃশ্য তৈরি করে, যেখানে একটি মোটা দড়ি সুঁইয়ের ছোট ছিদ্র দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, যা অসম্ভব। এভাবে বিমূর্ত ধারণা জীবন্ত হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন

আবার, কাফিরদের কাজের নিষ্ফলতা বোঝাতে কোরআন বলে, “যারা তাদের প্রতিপালককে অবিশ্বাস করেছে, তাদের কাজের উপমা হলো ঝড়ো দিনে বাতাসে উড়ে যাওয়া ছাইয়ের মতো।” (সুরা ইবরাহিম, আয়াত: ১৮)

এই চিত্র মানুষের মনে ছাই উড়ে যাওয়ার দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে। একইভাবে, রিয়া বা লোক দেখানো দানের বর্ণনায় কোরআন বলে, “তার উপমা এমন একটি মসৃণ পাথরের মতো, যার উপর মাটির পাতলা স্তর ছিল। তারপর প্রবল বৃষ্টি এসে তাকে একেবারে পরিষ্কার করে ফেলল।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬৪)

এই চিত্র মাটির পাতলা স্তরে ঢাকা পাথরের উপর বৃষ্টির প্রভাব বর্ণনা করে। অন্যদিকে, আল্লাহ মহানের সন্তুষ্টির জন্য দানের উপমা দেওয়া হয়েছে, “একটি উঁচু জমির বাগানের মতো, যার উপর বৃষ্টি পড়লে তা দ্বিগুণ ফল দেয়। আর যদি বৃষ্টি না পড়ে, তবে হালকা শিশিরেও তা ফল দেয়।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬৫)

এখানে বৃষ্টি দুই ক্ষেত্রেই আছে, কিন্তু একটিতে ধ্বংস করে, আরেকটিতে উর্বরতা বাড়ায়।

যে আল্লাহ মহানের সঙ্গে শরিক করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ে গেল, তারপর পাখি তাকে ছিনিয়ে নিল, অথবা বাতাস তাকে দূরবর্তী গহীন জায়গায় ফেলে দিল।
সুরা হজ, আয়াত: ৩১

অন্য দেবতাদের অক্ষমতা বোঝাতে কোরআন বলে, “যাদের তারা আল্লাহ মহান ছাড়া ডাকে, তারা কিছুই জবাব দিতে পারে না। তারা এমন একজনের মতো, যে পানির দিকে হাত বাড়ায় যেন তা তার মুখে পৌঁছায়, কিন্তু তা কখনো পৌঁছায় না।” (সুরা রাদ, আয়াত: ১৪)

এটি মূর্খতার একটি জীবন্ত চিত্র। আবার মুশরিকদের কাজের নিষ্ফলতা বর্ণনায় বলা হয়েছে, “যে আল্লাহ মহানের সঙ্গে শরিক করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ে গেল, তারপর পাখি তাকে ছিনিয়ে নিল, অথবা বাতাস তাকে দূরবর্তী গহীন জায়গায় ফেলে দিল।” (সুরা হজ, আয়াত: ৩১)

এভাবে কোরআন বিমূর্ত ধারণাগুলোকে জীবন্ত চিত্রে রূপান্তরিত করে।

মানসিক অবস্থার ক্ষেত্রেও কোরআন এই শৈল্পিক চিত্রায়ণ ব্যবহার করে। যেমন, অবিশ্বাসীদের বিভ্রান্তি বোঝাতে বলা হয়েছে, “আমাদেরকে পেছনে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা এমন একজনের মতো, যাকে শয়তান পৃথিবীতে বিভ্রান্ত করেছে। তার সঙ্গীরা তাকে হিদায়াতের দিকে ডাকে, কিন্তু সে বিভ্রান্ত ও দিশেহারা।” (সুরা আনআম, আয়াত: ৭১)

আবার, দুর্বল ইমানের বর্ণনায় বলা হয়েছে, “কিছু মানুষ আল্লাহর ইবাদত করে প্রান্তে দাঁড়িয়ে। যদি তার কাছে ভালো কিছু আসে, তবে সে তাতে সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু যদি কোনো পরীক্ষা আসে, তবে সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” (সুরা হজ, আয়াত: ১১)

এই চিত্রগুলো মানসিক অবস্থাকে জীবন্ত করে তোলে।

কিয়ামতের দৃশ্য, নিয়ামত ও আজাবের বর্ণনায় এই চিত্রায়ণের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। যেমন, “তাকে ধরো, তারপর তাকে বেঁধে জাহান্নামে নিক্ষেপ করো। তারপর তাকে সত্তর হাত লম্বা শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলো।” (সুরা হাক্কা, আয়াত: ৩০-৩২)

আবার, “সেদিন তোমরা দেখবে প্রতিটি দুধ খাওয়ানো মা তার শিশুকে ভুলে যাবে, প্রতিটি গর্ভবতী তার গর্ভপাত করবে এবং মানুষকে মনে হবে মাতাল, যদিও তারা মাতাল নয়। কিন্তু আল্লাহর আজাব অত্যন্ত কঠিন।” (সুরা হজ, আয়াত: ২)

এই দৃশ্যগুলো হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে।

আরও পড়ুন

জড়বস্তুর গতিশীলতা

কোরআনের চিত্রায়ণে জড় বস্তুকেও গতিশীল করে তোলা হয়। যেমন, “যখন সকাল নিশ্বাস নেয়।” (সুরা তাকভির, আয়াত: ১৮)

এই চিত্রে সকালকে প্রাণবান করে তোলা হয়েছে, যেন তা নিশ্বাস নিচ্ছে এবং জীবনের সঞ্চার করছে। আবার, আসমান ও পৃথিবীকে বুদ্ধিমান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে: “তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন, যখন তা ছিল ধোঁয়া। তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, ‘তোমরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এসো।’ তারা বলল, ‘আমরা স্বেচ্ছায় এসেছি’।” (সুরা ফুসসিলাত, আয়াত: ১১)

জাহান্নামকে বর্ণনা করা হয়েছে এমনভাবে, যেন তা রাগে ফুঁসছে: “যখন তারা দূর থেকে তাকে দেখবে, তখন তারা তার গর্জন ও ফুঁসফুঁস শুনবে।” (সুরা ফুরকান, আয়াত: ১২)

সুরা নাস পড়ার সময় কণ্ঠস্বরে এমন একটি ফিসফিস ধ্বনি সৃষ্টি হয়, যা সুরার পরিবেশের সঙ্গে মানানসই।

এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আমাদের কোরআনের ভাষা, ছন্দ ও চিত্রায়ণের প্রতি গভীর মনোযোগ দিতে হবে। এটি কেবল পড়ার জন্য নয়, বরং হৃদয় দিয়ে অনুভব করার জন্য।

ছন্দ ও লয়ের বৈচিত্র্য

কোরআনের ছন্দ ও লয় সুরার অর্থ ও পরিবেশের সঙ্গে মিল রেখে পরিবর্তিত হয়। যেমন, পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন, সুরা মরিয়মে প্রথমে আয়াতগুলো ‘ইয়া’ দিয়ে শেষ হয়: “তোমার রবের দয়ার কথা স্মরণ কর, তাঁর বান্দা যাকারিয়ার।” ( আয়াত: ২)

কিন্তু যখন সুরা ঈসা (আ.)-এর বিষয়ে হুকুম জারি করে, তখন তা ‘নুন’ বা ‘মিম’-এ পরিবর্তিত হয়: “এটি ইসা ইবনে মরিয়ম, সত্যের কথা, যে বিষয়ে তারা সন্দেহ করে।” (আয়াত: ৩৪)

এই পরিবর্তন হুকুমের গাম্ভীর্যের সঙ্গে মানানসই। সুরা নাবার শুরুর দিকে আয়াতের সমাপ্তিতে ‘নুন’ ও ‘মিম’ ব্যবহৃত হয়েছে, যা তথ্য প্রকাশের জন্য উপযুক্ত: “তারা কী নিয়ে প্রশ্ন করছে? সেই মহান সংবাদ সম্পর্কে।” (আয়াত: ১-২)

কিন্তু যখন বর্ণনা শুরু হয়, তখন তা বদলে যায়: “আমি কি পৃথিবীকে বিছানা করিনি? এবং পাহাড়কে খুঁটি করিনি?” (আয়াত: ৬-৭)।

সুরা নাজিয়াতে দ্রুত, সংক্ষিপ্ত ও তীব্র ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে: “যেদিন কম্পমান বস্তু কাঁপবে, তারপরে অনুসরণকারী আসবে।” (আয়াত: ৬-৭)। কিন্তু মূসা (আ.)-এর গল্পে ছন্দ ধীর ও গল্পের সঙ্গে মানানসই হয়: “তোমার কাছে কি মূসার খবর এসেছে? যখন তার রব তাকে পবিত্র তুয়া উপত্যকায় ডেকেছিলেন।” (আয়াত: ১৫-১৬)

বৃহৎ চিত্রায়ণ

কোরআন বৃহৎ দৃশ্যপটও তৈরি করে: “তারা কি উটের দিকে তাকায় না, কীভাবে তা সৃষ্ট হয়েছে? আকাশের দিকে তাকায় না, কীভাবে তা উত্থাপিত হয়েছে? পাহাড়ের দিকে তাকায় না, কীভাবে তা স্থাপিত হয়েছে? পৃথিবীর দিকে তাকায় না, কীভাবে তা সমতল করা হয়েছে?” (সুরা গাশিয়া, আয়াত: ১৭-২০)

এই চিত্রে আকাশ, পৃথিবী, পাহাড় ও উট একটি একক দৃশ্যে একত্র হয়েছে। আবার, সময়, স্থান, দৃশ্যমান ও অদৃশ্যের সমন্বয়ে আরেকটি চিত্র: “নিশ্চয় আল্লাহ মহানের কাছে কিয়ামতের জ্ঞান আছে, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন, তিনি জানেন গর্ভে কী আছে। কোনো ব্যক্তি জানে না আগামীকাল সে কী অর্জন করবে এবং কোনো ব্যক্তি জানে না কোন জমিনে সে মারা যাবে।” (সুরা লুকমান, আয়াত: ৩৪)

এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে

কোরআনের শৈল্পিক চিত্রায়ণ তার অলৌকিকতার একটি প্রধান দিক। এটি বিমূর্ত ধারণাগুলোকে জীবন্ত চিত্রে রূপান্তরিত করে, জড় বস্তুকে গতিশীল করে এবং ছন্দ ও লয়ের কাফিয়ার মাধ্যমে অর্থের সঙ্গে পরিবেশের সমন্বয় সাধন করে। এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আমাদের কোরআনের ভাষা, ছন্দ ও চিত্রায়ণের প্রতি গভীর মনোযোগ দিতে হবে। এটি কেবল পড়ার জন্য নয়, বরং হৃদয় দিয়ে অনুভব করার জন্য।

আরও পড়ুন