স্বজাতিকে বাঁচাতে চাইল যে কাঠমিস্ত্রি

কোরআনে আল্লাহ ‘এক জনপদের অধিবাসীদের দৃষ্টান্ত’ বর্ণনা করে বলেছেন, ‘যখন তাঁদের কাছে এসেছিল রাসুলগণ।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ১৩)

এই জনপদের নাম কোরআনে উল্লেখ নেই। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক, ইবনে আব্বাস, কাব ইবনে আহবার ও ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বেহ’র মতো ইতিহাসবেত্তগণ বলেছেন, জনপদটির নাম ‘আন্তাকিয়া’। মুজামুল বুলদান গ্রন্থে আছে, আন্তাকিয়া শাম অঞ্চলের প্রাচীন নগরী। এটি বর্তমান তুরস্কে অবস্থিত। সেই যুগে সমৃদ্ধি ও স্থাপত্যে প্রসিদ্ধ ছিল আন্তাকিয়া। নগরীটি দর্শনার্থীদের চোখ আটকে রাখত নিজস্ব সৌন্দর্যে। এতে খ্রিষ্টানদের সোনা-রুপার কারুকার্য খচিত বড় বড় গির্জা ছিল। সাহাবি আবু উবায়দা ইবনে জাররা (রা.) এ শহর জয় করেন। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, মূল: মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা: ১,১২৯)

আন্তাকিয়ার অধিবাসীরা আল্লাহর একত্ববাদকে অস্বীকার করত। তাদের বাদশাহ আন্তিখিস বিন আন্তিখিসও ছিলেন বহু ঈশ্বরের পূজারী। তাঁদের হেদায়াতের জন্য আল্লাহ তিনজন রাসুল পাঠান—সাদেক, সাদুক ও শালুম। কোনো বর্ণনায় আছে, তৃতীয়জনের নাম শাকুম। (কাসাসুল কোরআন, মূল: মাওলানা হিফজুর রহমান, অনুবাদ: আবদুস সাত্তার আইনী, ৭/২৪)

আরও পড়ুন

রাসুলরা আন্তাকিয়াবাসীকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিলেন। তারা মুখ ফিরিয়ে নিল। তাঁদের মিথ্যাবাদী বলল। তাঁরা দাওয়াত অব্যাহত রাখলেন। অবিশ্বাসীরা বিরক্ত হলো। রাসুলদের মেরে ফেলার ফন্দি করল।

সেসময় শহরের প্রান্তে থাকতেন হাবিব নাজ্জার নামে এক বিশ্বাসী মানুষ। তিনি ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি। শহরের শেষ প্রান্তে থাকতেন তিনি। তাঁর ছিল কুষ্ঠরোগ। রোগের সুস্থতায় বহু চিকিৎসা করেছেন। তখনকার দেব-দেবীর কাছে ৭০ বছর প্রার্থনা করেছেন—ফল পাননি।

তিনজন রাসুল শহরের প্রান্তবর্তী প্রবেশপথ দিয়ে আন্তাকিয়ায় ঢোকার সময় পথে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা তাঁকে একাত্ববাদের দাওয়াত দেন। তিনি বললেন, ‘এতে আমার লাভ কী?’ তাঁরা বললেন, ‘তোমার রোগমুক্তির জন্য আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করব। তিনি তোমাকে রোগমুক্তি করবেন।’ তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, ৭০ বছর ধরে প্রার্থনা করে লাভ হয়নি, আপনাদের ‘আল্লাহ’ একদিনে কী করে সুস্থ করবেন।’ তাঁরা বললেন, তিনি সর্বশক্তিমান। হাবিব নাজ্জার ইমান আনলেন এবং তাঁদের প্রার্থনায় তার নিরাময় হলো।

আরও পড়ুন

তাঁর ইমান আরও মজবুত হলো। তিনি নির্জনে নগরীর এক প্রান্তে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল রইলেন। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে থাকলেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির, সুরা ইয়াসিন; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১/২২৯)

এভাবে কেটে গেল বহু দিন। এর মধ্যে রাসুলদের বিরুদ্ধে শহরবাসীর বিক্ষোভের খবর পেলেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি শহরে ছুটে এলেন। শহরবাসীকে সতর্ক করতে থাকলেন এবং বোঝাতে লাগলেন। কাজ হলো না। তারা বরং তাঁকে ঝামেলা মনে করল। তাঁর ওপর উদ্যত হলো। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘লাথি মেরে মেরে সবাই তাঁকে শহিদ করে দিল। বেদম প্রহারের সময়ও তিনি বলছিলেন, হে আমার পালনকর্তা, আমার সম্প্রদায়কে হেদায়াত দান করুন।’ (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, মূল: মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা: ১,১৩১)

আল্লাহ তাঁকে এর বিনিময়ে জান্নাত দিলেন। তিনি জান্নাতের নেয়ামত দেখে সম্প্রদায়ের লোকদের কথা মনে করে আফসোস করছিলেন, যা কোরআনে উল্লেখ রয়েছে এভাবে যে, ‘তাকে বলা হলো, তুমি জান্নাতে প্রবেশ করো।’ সে বলল, ‘হায়! আমার জাতি যদি জানতে পারত যে আমার রব আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন!’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ২৬-২৭)

ওদিকে আল্লাহ আন্তাকিয়াবাসীকে ধ্বংস করে দেন। এর জন্য তিনি কোনো ফেরেশতা পাঠাননি। জিবরাইল (আ.)-কে শুধু আওয়াজ দিতে আদেশ করলেন। জিবরাইল (আ.) এমন ভয়ংকর গর্জন করে উঠলেন, তা শুনে জনপদের অধিবাসীরা যে যেখানে ছিল, সে অবস্থায় মরে পড়ে থাকল। (তাফসিরে ইবনে কাসির, সুরা ইয়াসিন; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১/২২৯)

আল্লামা ইবনে কাসির ও ইমাম বুখারি (রহ.)-এর মতে, এই ঘটনা ঘটেছিল ইসা (আ.)-এর পূর্ববতী সময়। (ফাতহুল বারি, খণ্ড ৬; তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড ৩; সুরা ইয়াসিন)

আরও পড়ুন