তারাবি কত রাকাত পড়বেন
তারাবি নামাজে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। তারাবি জামাতের সঙ্গে পড়া হয় এবং রমজান মাসের রাতে পড়া হয়।
সুতরাং কেউ যদি কিয়ামুল লাইলের সওয়াব পেতে চায়, তাহলে তার উচিত হবে জামাতের সঙ্গে তারাবি আদায় করা এবং ইমাম যত রাকাতই পড়ুন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার অনুসরণ করে যাওয়া। কেননা হাদিসে রয়েছে, যে-ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে নামাজ পড়ে এবং তার নামাজ শেষ করা পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকে, সেই ব্যক্তির জন্য সারা রাত্রি ‘কিয়াম’ করার সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হয়। (আবু দাউদ, হাদিস: ১২২৭)
অন্য হাদিসে আরও বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। আবু যর (রা.) বলেন, ‘আমরা রাসুলের (সা.) সঙ্গে রোজা পালন করেছি। যখন মাসের মাত্র সাত দিন বাকি ছিল, তখন তিনি আমাদের নিয়ে রাতের এক-তৃতীয়াংশ নামাজ আদায় করলেন। ষষ্ঠ দিনে তিনি আমাদের সঙ্গে নামাজ আদায় করেননি। পঞ্চম রাতে অর্ধরাত্রি আমাদের নিয়ে নামাজ আদায় করলেন। আমরা আরজ করলাম, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.), আপনি বাকি সময়টুকুও যদি আমাদের নিয়ে নফল নামাজে কাটাতেন!’ তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি ইমাম নামাজ সমাপ্তি করা অবধি তার সঙ্গে নামাজ আদায় করবে, তার জন্য পূর্ণ রাত্রি নামাজ আদায়ের সওয়াব লিখে দেওয়া হবে।’ অতঃপর তিনি শেষ তিন রাত বাকি থাকা পর্যন্ত আর আমাদের নিয়ে নামাজ আদায় করলেন না। তৃতীয় রাত্রিতে আমাদের নিয়ে নামাজ আদায় করলেন। স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনদের ডেকে নিলেন। এতটা সময় তিনি আমাদের সঙ্গে রাত্রি জাগরণ করেছিলেন যে, সাহরির সময় ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় হচ্ছিল।’ ( তিরমিজি, হাদিস: ৮০৬)
সুতরাং যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে নামাজ পড়ে এবং কিয়ামুল লাইলের সওয়াব পেতে চায়, তাকে অবশ্যই ইমাম যত রাকাত পড়ান, তার পুরোটাতেই অংশগ্রহণ করতে হবে—এ-ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। এ-হাদিস এটাও প্রমাণ করে—তারাবি নামাজের রাকাতের সংখ্যার ক্ষেত্রে ব্যক্তি-বিশেষের সীমা-আরোপ করা এবং ইমামের নামাজ সমাপ্তির পূর্বেই প্রস্থান করা বৈধ হলেও তা কিছুতেই উত্তম ও প্রশংসনীয় নয়। যারা এভাবে বিষয়টির ‘ইজতিহাদ’ (বিভিন্ন বিষয়ে ওলামাদের গবেষণাকে ইজতিহাদ বলে) করেন, তাদের ইজতিহাদ পূর্ণ এক রাত্রির সওয়াব বিনষ্ট করা ব্যতীত কোনও সুফল বয়ে আনবে না।
একদল আলেম মনে করেন, বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করে নামাজির ওপর। সে যদি মনে করে, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে, তাহলে তার জন্য ভালো হয় দীর্ঘ সময় ধরে দশ রাকাত তারাবি এবং ৩ রাকাত বিতর পড়া। কেননা, রাসুল (সা.) এভাবেই পড়েছেন। কিন্তু সে যদি টানা দাঁড়িয়ে থাকতে না পারে, তাহলে উচিত ছোট ছোট করে বিশ রাকাত তারাবি পড়া। কারণ সাহাবায়ে কেরাম এভাবেও আমল করেছেন এবং বর্তমান মুসলিম সমাজেও এটা বেশ প্রচলিত। ইমাম আহমাদ (রহ.), ইমাম ইবনে হাজার (রহ.), ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-সহ বহু ইমামের দৃষ্টিভঙ্গি এমনটাই। (ফাতহুল বারি, ৪/২৯৮); ইমাম তাইমিয়া, মাজমুঊ ফাতাওয়া, ২৩/১১৩)
শায়েখ ইবনে উসাইমিনকে জিজ্ঞেস করা হলো, ইমামের পেছনে নামাজ পড়তে গিয়ে যদি মুসল্লি দেখে যে, ইমাম এগারো রাকাআতের বেশি পড়ছেন, তখন সে ইমামের অনুসরণ করবে নাকি কিয়াম থেকে ফিরে আসবে? তিনি বলেন, সুন্নত হলো ইমামের অনুসরণ করা। কেননা, যদি সে ইমামের নামাজ সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে ফিরে আসে, তবে তার ‘কিয়ামুল লাইল’র সওয়াব মিলবে না। সাহাবিগণ নামাজের মতো শরয়ি বিধানে ‘অতিরিক্ত বৃদ্ধি’ করার পরও তাদের ইমামের অনুসরণ করেছেন। ওসমান ইবনে আফফান (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, রাসুল (সা.), আবু বকর (রা.), ওমর (রা.) এমনকি ওসমান (রা.)-এর প্রথম আট বছর এভাবে অতিবাহিত হলো যে, তারা সবাই হজের সময় মিনাতে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়তেন। কিন্তু এর পরে এসে ওসমান (রা.) চার রাকাত পড়া শুরু করেন। সাহাবিরা তার মতটি মানেন নি, তবুও তাকে অনুসরণ করে তারা চার রাকাত নামাজ পড়েন। যদি ইমামের অনুসরণের প্রতি গুরুত্ব দেওয়াই হয় সাহাবিদের প্রদর্শিত পথ, তবে আজকাল যে কতিপয় মানুষ ইমামের নামাজ সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে ‘এগারো রাকাতই শরয়ি হুকুম’—এ অজুহাতে সরে পড়ে, আমরা বলব, শরিয়তের দৃষ্টিতে ইমামের অনুসরণই অধিক ওয়াজিব। (ইবনে উসাইমিন, মাজমুঊ ফাতাওয়া, ১/১৯৪-১৯৬)