নামাজ ইসলামের অন্যতম প্রধান ইবাদত এবং মুমিনদের সফলতার সোপান। আল্লাহ্ তায়ালা সফল মুমিনদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, “যারা তাদের নামাজে বিনয়ী।” (সুরা মুমিনুন, আয়াত: ১-২)
নামাজে এই বিনয় বা একাগ্রতা, যাকে কোরআনে বলা হয়েছে ‘খুশু’, তা অর্জন করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল দৃষ্টির অবস্থান।
যদি মুসল্লি এদিক-ওদিক দৃষ্টি ফেরান, তাহলে তার মন নামাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং খুশু নষ্ট হয়ে যায়। তাই খুশু রক্ষার জন্য দৃষ্টিকে সঠিক স্থানে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
যদি মুসল্লি এদিক-ওদিক দৃষ্টি ফেরান, তাহলে তার মন নামাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং খুশু নষ্ট হয়ে যায়। তাই খুশু রক্ষার জন্য দৃষ্টিকে সঠিক স্থানে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
আকাশের দিকে তাকানো বারণ
নামাজ অবস্থায় দৃষ্টিকে আকাশের দিকে তোলা ইসলামে নিষিদ্ধ। কারণ এটি খুশুর পরিপন্থী এবং আল্লাহর প্রতি যথাযথ বিনয় প্রদর্শনের বিপরীত।
এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “ঐসব লোকের কী হল, যারা তাদের নামাজে আকাশের দিকে তাদের দৃষ্টি উত্তোলন করে! তাদের অবশ্যই এ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে, নতুবা তাদের চোখগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৫০)
এই নিষেধাজ্ঞা প্রমাণ করে যে, নামাজে এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যা খুশু বা বিনয়ের পরিবেশ থেকে ব্যক্তিকে দূরে সরিয়ে দেয়।
দৃষ্টির অবস্থান নিয়ে ফকিহদের মত
দৃষ্টি কোথায় থাকবে, এই বিষয়ে ফিক্হবিদদের মধ্যে তিনটি প্রধান মত রয়েছে। তবে সবার মতামতের মূল কথা হলো: খুশু বা একাগ্রতা যেখানে বেশি হবে, দৃষ্টি সেখানেই থাকবে।
ক. সিজদার স্থানে দৃষ্টি: হানাফি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকিহদের মতে, নামাজরত অবস্থায় মুসল্লির দৃষ্টি সেজদার স্থানে নিবদ্ধ থাকা মুস্তাহাব। এর সপক্ষে যুক্তি হল, সিজদার স্থানে দৃষ্টি রাখলে মন বিক্ষিপ্ত হয় না এবং খুশূ' অর্জিত হয়। এই অবস্থান বিনয় প্রকাশের সবচেয়ে কাছাকাছি।
কোনো কোনো আলেম নামাজের বিভিন্ন রোকনে দৃষ্টির স্থান নির্দিষ্ট করেছেন, যা খুশু অর্জনে সহায়ক:
দাঁড়িয়ে থাকা (কিয়াম): সিজদার স্থানে দৃষ্টি রাখা।
রুকুতে থাকা: পায়ের পাতার দিকে দৃষ্টি রাখা।
সিজদার সময়: নাকের ডগার দিকে দৃষ্টি রাখা।
বসা অবস্থায়: কোলের (হাঁটু ও উরুর সংযোগস্থল) দিকে দৃষ্টি রাখা।
আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইয়িদ আহমদ আল-মুসাইয়ির এই মতের সঙ্গে একমত পোষণ করেন যে খুশু এবং আল্লাহর প্রতি মনোযোগ ধরে রাখাই মূল উদ্দেশ্য।
খ. কিবলার দিকে দৃষ্টি: মালিকি মাজহাবের মতে, মুসল্লি কিবলা বা সম্মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। এই মতের ভিত্তি হল, আল্লাহ্ তায়ালা কিবলা পরিবর্তনের সময় বলেন, “আমি আপনার চেহারাকে আকাশের দিকে ফেরাতে দেখছি। অতএব, আমি অবশ্যই আপনাকে এমন কিবলার দিকে ঘুরিয়ে দেব, যা আপনি পছন্দ করেন।
সুতরাং আপনি আপনার চেহারা মসজিদে হারামের (কাবা শরিফের) দিকে ঘোরান এবং তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তোমরা তোমাদের চেহারা সেদিকেই ফেরাও।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৪৪)
তাদের মতে, এই আয়াতে কিবলার দিকে মুখ ফেরানোর নির্দেশ কেবল দেহকে নয়, বরং দৃষ্টিকেও কিবলার দিকে নিবদ্ধ করার প্রতি ইঙ্গিত করে।
তা ছাড়া নবীজি (সা.) সাহাবিদের নিয়ে নামাজ পড়ার পর মিম্বরে আরোহণ করলেন এবং হাতের ইশারায় মসজিদের কিবলার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “আমি এইমাত্র, যখন তোমাদের নিয়ে নামাজ পড়লাম, জান্নাত ও জাহান্নামকে এই দেয়ালের কিবলার দিকে প্রতিমূর্ত হতে দেখেছি। আজকের মতো ভালো ও মন্দ আমি দেখিনি।”
মালিকিগণ বলেন, এই হাদিস প্রমাণ করে যে রাসুল (সা.) সামনের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন (যা কিবলার দিক)।
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত: খুশুই মূল লক্ষ্য
যদিও ফিকহবিদদের মধ্যে দৃষ্টির অবস্থান নিয়ে সামান্য পার্থক্য রয়েছে, তবে সবাই একমত যে নামাজের মূল উদ্দেশ্য হলো খুশু বা একাগ্রতা অর্জন। খুশুর জন্য একজন মুসলিমের উচিত আল্লাহর মহিমা ও মহত্ত্ব স্মরণ করা, শান্তভাবে রুকু ও সেজদা করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে স্থির রাখা।
সুতরাং, নামাজে ব্যক্তির দৃষ্টি সেজদার স্থানেই থাকুক বা সম্মুখের কিবলার দিকে, গুরুত্বপূর্ণ হল—কোন অবস্থানে তার মন সবচেয়ে কম বিক্ষিপ্ত হয় এবং আল্লাহর দিকে তার মনোযোগ সর্বাধিক নিবদ্ধ থাকে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিকহবিদদের (হানাফি, শাফেয়ি, হাম্বলি) মতে সিজদার স্থানে দৃষ্টি রাখা খুশু অর্জনের জন্য সর্বোত্তম। তবে মালিকিদের মতে কিবলার দিকে সরাসরি তাকানো বৈধ। উভয় মতের লক্ষ্য হল, চোখকে বিক্ষিপ্ত হওয়া থেকে বাঁচিয়ে আল্লাহর সাথে সংযোগকে দৃঢ় করা।
নামাজে দৃষ্টির অবস্থান কেবল একটি বাহ্যিক নিয়ম নয়, এটি অভ্যন্তরীণ বিনয় ও একাগ্রতার প্রতিফলন। যখন একজন মানুষ তার দৃষ্টিকে সেজদার স্থানে স্থির রাখে, তখন তা শয়তানের কুমন্ত্রণা এবং বাইরের জগত থেকে মনকে দূরে রাখতে সহায়তা করে, যার ফলে তার নামাজ আল্লাহর কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হওয়ার আশা করা যায়।