হাশরের বিচারে প্রশ্নোত্তর

‘মালিকি ইয়াওমিদ্দিন’ তিনি মহান রাব্বুল আলামিন, বিচারদিনের মালিক (সুরা-১ ফাতিহা, আয়াত: ৩)। এ আয়াত আমরা প্রতিদিন নামাজে প্রতি রাকাতে ওয়াজিব বা অত্যাবশ্যকীয়ভাবে পাঠ করি। দুনিয়ার জীবন আখিরাতের কর্মক্ষেত্র বা পরীক্ষাকেন্দ্র। কোরআনে আরও আছে, ‘প্রাচুর্যময় তিনি, যাঁর হাতে রাজ্যক্ষমতা আর তিনি সব বিষয়ে শক্তিমান। যিনি সৃজন করেছেন নিশ্চিত মরণ ও সম্ভাবনাময় জীবন, যাতে পরীক্ষা করবেন তোমাদের কারা কাজে ভালো। আর তিনি পরাক্রমশালী ও বড় ক্ষমাশীল’ (সুরা-৬৭ মুলক, আয়াত: ১-২)।

কবর বা বারজাখ জগতের পরিসমাপ্তির পর শুরু হবে আলমে আখিরাত বা পরকাল। এর সূচনাকে বলা হয় চূড়ান্ত কিয়ামত। যেদিন আল্লাহর হুকুমে হজরত ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙ্গায় ফুৎকারের মাধ্যমে সবাই পুনরায় জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানে একত্র হবে। এদিনকে বলা হয় কিয়ামত দিবস। কিয়ামত অর্থ দাঁড়ানো। যেহেতু এদিন বিচারের পূর্ব পর্যন্ত সবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, তাই একে কিয়ামত দিবস বলা হয়। হাশর মানে একত্র হওয়া, নশর মানে প্রকাশিত বা উত্থিত হওয়া। এই দিন সব মানুষ উঠবে এবং একত্র হবে, তাই একে ‘হাশর নশর’ বলা হয়। এই দিন সবাই নিজ নিজ কর্মফলপ্রাপ্ত হবে, তাই এটি ‘ইয়াউমুদ্দিন’ বা কর্মফল দিবস।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে নবী! আপনি বলুন) তোমরা তোমাদের কর্মফল ভোগ করবে এবং আমি আমার কর্মফল লাভ করব’ (সুরা-১০৯ কাফিরুন, আয়াত: ৬)।

ইমানের মৌলিক সাতটি বিষয়ের মধ্যেও পরকালে বিশ্বাস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা ইমানে মুফাসসালে বলা হয়েছে, ‘আমি বিশ্বাস করলাম আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রাসুলদের প্রতি, পরকালের প্রতি, তাকদির বা ভাগ্যের প্রতি, যার ভালো-মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে ফয়সালা হয় আর বিশ্বাস করি মৃত্যুও পর পুনরুত্থানের প্রতি।’

হাশরের বিচারে মানুষ তার জীবনের ভালো-মন্দ কর্মফলের চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করবে। তাই দিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হাশরের দিনটি হবে অত্যন্ত দীর্ঘ। পবিত্র কোরআনের বর্ণনায়, ‘সেই দিনের পরিমাণ তোমাদের গণনায় সহস্র বৎসর’ (সুরা-৩২ সাজদা, আয়াত: ৫)। ‘ওই দিনের পরিমাণ ৫০ হাজার বছর’ (সুরা-৭০ মাআরিজ, আয়াত: ৪)। সূর্য মাথার অর্ধহাত নিকটে থাকবে, নিচে তামার জমিন হবে। নেককার ইমানদারেরা আরশের ছায়ায় স্থান পাবেন। গুনাহগারেরা ঘামতে থাকবে। পাপের পরিমাণ হিসাবে কষ্টের ও ঘামের পরিমাণ হবে।

এই দিন সম্পর্কে হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন কোনো আদম সন্তান পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও নড়তে পারবে না—জীবন সে কী কাজে ব্যয় করেছে, তারুণ্য ও যৌবনকালে কী করেছে, কোন পথে সম্পদ উপার্জন করেছে, আর কোন জায়গায় সম্পদ ব্যয় করেছে এবং সে তার জ্ঞান ও বিদ্যানুযায়ী কী আমল করেছে’ (তিরমিজি: ২৪১৬)।

আর কোরআনে বলা হচ্ছে, ‘সুতরাং যার নেকির পাল্লা ভারী হবে, সে থাকবে মহাসুখে; আর যার নেকির পাল্লা হালকা হবে, তার স্থান হবে হাবিয়া দোজখে।’ (সুরা-১০১ কারিআ, আয়াত: ৬-৯)

সুতরাং প্রতিমুহূর্তে জীবন পরিচালনায় ও কর্ম সম্পাদনায় শেষ বিচারের দিনের পাঁচটি প্রশ্ন স্মরণ করে চললেই সেদিন উত্তর দেওয়া সহজ হবে। দুনিয়ায় অন্যায়-অপরাধ থেকে বেঁচে থাকাও সহজতর হবে। হাদিসে এসেছে, ‘বুদ্ধিমান সে, যে আত্মসমালোচনা করে ও পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।’ নবীজি (সা.) পরকালের হিসাব সহজ হওয়ার জন্য দোয়া শিখিয়েছেন, ‘আল্লাহুম্মা হাছিবনি হিছাবাই ইয়াছিরা, অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমার হিসাব সহজ করুন’ (মুসনাদে আহমাদ: ২৪২১৫)।

এ দোয়া সদাসর্বদা পড়তে হবে। এর মানে হলো পরকালে হাশরের বিচারকে বেশি বেশি স্মরণ রাখতে হবে। এক মুহূর্তের জন্য পরকালকে এবং হিসাব-নিকাশকে ভুললে চলবে না। তা না হলে জীবন লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে, পাপাচারে লিপ্ত হবে, অন্যায় অপরাধে জড়িয়ে যাবে, তখন মুক্তির পথ কঠিন হবে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী­

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]