যুদ্ধ না করেও যিনি শহীদ

৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত হয় নবীজির (সা.) তাবুক অভিযান। এই তাবুক অভিযানের সময় একটি বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি ছিল তরুণ সাহাবি আবদুল্লাহ জুলবিজাদাইনকে নিয়ে। তার ঘটনাটি বলতে হলে জানতে হবে তার আগেকার জীবনও।

ইয়েমেনের সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। সেই ছোট্ট গ্রামটিতে বাস করত এক মধ্যবিত্ত পরিবার। স্বামী-স্ত্রী ও আদরের এক ছেলে। তাঁরা ছেলেটির নাম রেখেছিলেন আবদুল উজ্জা।

আচমকাই একদিন মারা গেলেন আবদুল উজ্জার পিতা। বাড়ির একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটি মারা গেলে স্বাভাবিকভাবেই উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারটিরও তা–ই হলো। অবশেষে অভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গ্রামের এক ব্যক্তিকে বিয়ে করতে বাধ্য হলেন আবদুল উজ্জার মা।

চাচার সংসারে থাকেন বালক আবদুল উজ্জা। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়। এভাবেই দিন কাটতে লাগল বালক আবদুল উজ্জার।

নতুন স্বামী ভালো মানুষ ছিলেন না। তিনি তাঁর নতুন স্ত্রীর আগের ছেলে আবদুল উজ্জাকে নিজের কাছে রাখতে অস্বীকৃতি জানালেন। উপায় না দেখে আবদুল উজ্জাকে নিজেদের কাছে রেখে দিলেন আবদুল উজ্জার চাচা।

চাচার সংসারে থাকেন বালক আবদুল উজ্জা। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়। এভাবেই দিন কাটতে লাগল বালক আবদুল উজ্জার।

একদিন তাদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল আরবের এক ব্যবসায়িক কাফেলা। উট চরাতে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হয় আবদুল উজ্জার। কথায় কথায় তাদের কাছে জানতে পারে, আরবে এক নতুন নবীর আবির্ভাব ঘটেছে। সত্য পথে মানুষকে ডাকছেন তিনি। মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিশা দিচ্ছেন তিনি। তার ধর্মে সামাজিক কোনো ভেদাভেদ নেই। এমন আরও অনেক কিছু।

আরও পড়ুন

এর পর থেকে আবদুল উজ্জা এ পথ দিয়ে যত কাফেলা যেত, সবার কাছে আরবের নবী সম্পর্কে জানতে চাইতেন। কেউ এক-আধটু জানলে তা বলে যেত তার কাছে। কেউ আবার তার সম্পর্কে অনেক জানত। তারাও তাকে শুনিয়ে যেত নতুন নবীর আগমনী বাণীসমূহ। এভাবেই আবদুল উজ্জার মনে যেন বান এল ইমানের, নবীপ্রেমের।

বছরের পর বছর চলে গেল। কিশোর থেকে তখন তিনি তরুণ হয়ে উঠেছেন। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় চাচাকে বলেই ফেললেন, ‘আমি এ বাড়ি থেকে চলে যাব।’

চাচা গম্ভীর মুখ করে বললেন, ‘তা কোথায় যাবে?’

উত্তরে আবদুল উজ্জা বললেন, ‘আমি মদিনায় চলে যাব। শুনেছি, সেখানে নাকি মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি আছেন, যিনি এতিম-অনাথদের লালন–পালন করেন। আবার শুনেছি, তিনি আল্লাহর নবী। আমি তাঁর হাতে হাত রেখে তাঁর ধর্মের দীক্ষা নিতে চাই।’

এ কথা শোনামাত্রই চাচা তাঁকে পেটাতে শুরু করলেন। পেটাতে পেটাতে একেবারে আধমরা করে ফেললেন। জ্ঞানহীন আবদুল উজ্জাকে ফেলে রাখলেন ঘরের দুয়ারে। অবশেষে আবদুল উজ্জার শরীর থেকে সব কাপড় খুলে রেখে তাঁর চাচা বললেন, ‘এবার তুই চলে যা। দূর হ আমার সামনে থেকে। তোর মুখ আর আমি দেখতে চাই না।’

‘আমি মদিনায় চলে যাব। শুনেছি, সেখানে নাকি মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি আছেন, যিনি এতিম-অনাথদের লালন–পালন করেন। আবার শুনেছি, তিনি আল্লাহর নবী। আমি তাঁর হাতে হাত রেখে তাঁর ধর্মের দীক্ষা নিতে চাই।’

ব্যথাভরা হৃদয় আর রক্তাক্ত শরীর নিয়ে রাতের আঁধারে আবদুল উজ্জা টলতে টলতে চলে এলেন তাঁর মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর বাড়িতে। মা দরজা খুলেই চমকে উঠলেন। আবদুল উজ্জা মাকে জানালেন সব। তাঁর মা মানা করলেন না। এমন অত্যাচারের চেয়ে অজানার উদ্দেশে নতুন পথের দিশা খুঁজে নেওয়া ভালো।

মা ঘর থেকে একটি চাদর এনে সেটিকে দুই টুকরা করে দিলেন। একটিকে লুঙ্গি বানিয়ে অপরটিকে শরীরে জড়িয়ে রাতের আঁধারে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নবীর কাছে আসার জন্য মদিনার পথে রওনা হলেন আবদুল উজ্জা।

কয়েক দিন নিরবচ্ছিন্ন পথ চলে আবদুল উজ্জা মদিনায় এসে পৌঁছালেন। নবীজি (সা.) তাকে বুকে টেনে নিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর আবদুল উজ্জার নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো আবদুল্লাহ। তিনি মাত্র দুই কাপড়ে মদিনায় চলে এসেছেন বলে নবীজি (সা.) আদর করে তাকে ডাকলেন ‘জুলবিজাদাইন’। জুলবিজাদাইন অর্থ দুই টুকরা চাদরওয়ালা। তাঁর নাম হলো আবদুল্লাহ জুলবিজাদাইন (রা.)।

আবদুল্লাহ জুলবিজাদাইন (রা.) মদিনায় আসার কিছুদিন পর নবম হিজরিতে (৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ) হঠাৎ ডাক এল তাবুক অভিযানের। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য হাজির হলেন মদিনার প্রায় সব সাহাবি। তাঁদের সঙ্গে এককাট্টা হয়ে গেলেন আবদুল্লাহও। তিনিও নাম লেখালেন সৈনিক হিসেবে।

আবদুল্লাহ জুলবিজাদাইন (রা.) নবীজির কাছে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। নবীজি (সা.) তাঁকে গাছের একটি ছাল নিয়ে আসতে বললেন। ছালটি নিয়ে এলে নবীজি (সা.) সেটা তাঁর হাতে বেঁধে দিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কাফেরদের জন্য আবদুল্লাহর রক্ত হারাম করে দিলাম।’

আবদুল্লাহ পেরেশান হয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি তো এটা চাইনি। আমিও তো শাহাদাত লাভ করতে চাই।’

নবীজি (সা.) বললেন, ‘চিন্তা কোরো না, যদি তুমি অসুস্থ হয়েও মারা যাও অথবা বাহন থেকে পড়েও মারা যাও, তবু তুমি শহীদ হিসেবে গণ্য হবে।’

আরও পড়ুন
এক রাতে নবীজির তাঁবুতে তাঁর ঊরুতে মাথা রেখেই আবদুল্লাহ বিদায় নিলেন আখিরাতের উদ্দেশ্যে। তাঁর পরম প্রিয় নবীর কোলেই মৃত্যু হলো তাঁর।

তাবুকের দিকে যাত্রা করল মুসলিম বাহিনী। কিন্তু তাবুক পৌঁছার আগেই পথে জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়লেন আবদুল্লাহ জুলবিজাদাইন (রা.)। ভীষণ জ্বর। কিছুতেই সারে না। মনে মনে বেদনায় মর্মাহত হতে লাগলেন তিনি। ইসলামের জন্য তাঁর প্রথম যুদ্ধে তবে কি তিনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন না?

ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে থাকেন আবদুল্লাহ। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না আর। এক রাতে নবীজির তাঁবুতে তাঁর ঊরুতে মাথা রেখেই আবদুল্লাহ বিদায় নিলেন আখিরাতের উদ্দেশ্যে। তাঁর পরম প্রিয় নবীর কোলেই মৃত্যু হলো তাঁর। যাঁকে দেখার জন্য পাড়ি দিয়ে এসেছিলেন দীর্ঘ পথ, তাঁর বাহুতে ব্যথার দহন এঁকে তিনি নিজেই চলে গেলেন জান্নাতের উদ্দেশ্যে।

রাতে আবদুল্লাহ জুলবিজাদাইনের কাফন-দাফন সম্পন্ন হলো। তাবুকের কাছাকাছি এক নিভৃত মরুভূমিতে খোঁড়া হলো জুলবিজাদাইনের কবর। নবীজির মুয়াজ্জিন বিলাল ইবনে রাবাহ (রা.) বাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নবীজি (সা.) জুলবিজাদাইনের জানাজার নামাজ পড়ালেন। আবু বকর এবং ওমর (রা.) তাঁর লাশ বহন করে নিয়ে এলেন কবরের পাশে। নবীজি (সা.) নিজে কবরে নেমে বললেন, ‘তোমরা দুজন তোমাদের ভাইকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’

নবীজি (সা.) নিজ হাতে আবদুল্লাহর প্রাণহীন দেহ কবরে শুইয়ে দিলেন। চোখভরা অশ্রু নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ, আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি এই যুবকের ওপর সন্তুষ্ট ছিলাম। তুমিও তার ওপর সন্তুষ্ট হও।’

নবীজি (সা.) খুব অল্প কয়েকজন মানুষকে দাফন করতে তাঁদের কবরে নেমেছেন। আবদুল্লাহ জুলবিজাদাইন তাঁদের একজন। তাঁর এমন সৌভাগ্য দেখে আবু বকর (রা.) আফসোস করে বললেন, ‘হায়! এই কবরে যদি আমি হতাম!’

তথ্যসূত্র: সিরাতে ইবনে হিশাম ২/৫২৮; যাদুল মা’আদ ৩/৪৭৩; নবীদের কাহিনী, ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ৬০১

আরও পড়ুন