জ্ঞান-বিজ্ঞানে নারী ০১
ইতিহাসে মুসলিম নারী চিকিৎসক
ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই চিকিৎসা শাস্ত্রে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। চিকিৎসা, নার্সিং, ওষুধ তৈরি, এমনকি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় মুসলিম নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। মধ্যযুগে মুসলিম নারী চিকিৎসকদের ভূমিকা নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক রচনার আজ প্রথম পর্ব।
মদিনার মসজিদে নববির ছায়ায় একটি তাঁবু স্থাপন করা হয়েছে। ভেতরে রুফায়দা আল-আসলামিয়া (রা.) একজন আহত সাহাবির বাহু থেকে তির বের করছেন। এই তাঁবু ইসলামি ইতিহাসের প্রথম মোবাইল হাসপাতাল, শুধু চিকিৎসার স্থান নয়, বরং মুসলিম নারীদের সাহস ও দক্ষতার প্রতীক।
আধুনিক সময়ে অনেকে মনে করেন, ইসলামি ইতিহাসে নারীদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে তেমন অবদান নেই, কিন্তু এই ধারণা সত্য নয়। মুসলিম নারীরা চিকিৎসা, নার্সিং, ওষুধ তৈরি, এমনকি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এই প্রবন্ধে আমরা ইসলামি ইতিহাসে মুসলিম নারী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ধর্মীয় ভিত্তি, তাদের বিশেষায়িত ভূমিকা এবং সমাজে তাদের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
রুফায়দা আল-আসলামিয়া (রা.) তাঁর পিতা সাদ আল-আসলামির কাছ থেকে চিকিৎসা শিখে বদর ও খন্দকের যুদ্ধে আহতদের সেবা করেন। তাঁর তাঁবু ছিল ইসলামি ইতিহাসের প্রথম মোবাইল হাসপাতাল।
ধর্মীয় ভিত্তি: চিকিৎসার প্রতি ইসলামের গুরুত্ব
ইসলাম চিকিৎসাকে বিশেষ মর্যাদা দেয়। কোরআন বলে, ‘যখন আমি অসুস্থ হই, তিনিই আমাকে সুস্থ করেন।’ (সুরা শুয়ারা, আয়াত: ৮০)
নবীজি (সা.) চিকিৎসার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, ‘হে আল্লাহর বান্দারা, চিকিৎসা গ্রহণ করো। কারণ, আল্লাহ যে রোগ দিয়েছেন, তার চিকিৎসাও দিয়েছেন, একটি রোগ ছাড়া।’ সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সেটি কী?’ তিনি বললেন, ‘বার্ধক্য।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩৮৫৫)
এই শিক্ষা মুসলিমদের রোগের চিকিৎসা ও ওষুধের জ্ঞান অনুসন্ধানে উৎসাহিত করেছে।
নবীযুগে নারীরা এই শিক্ষার অংশ হিসেবে চিকিৎসায় অংশ নিয়েছেন। রুফায়দা আল-আসলামিয়া (রা.) তাঁর পিতা সাদ আল-আসলামির কাছ থেকে চিকিৎসা শিখে বদর ও খন্দকের যুদ্ধে আহতদের সেবা করেন। তাঁর তাঁবু ছিল ইসলামি ইতিহাসের প্রথম মোবাইল হাসপাতাল। (ইবনে হাজার আল-আসকালানি, আল-ইসাবা ফি তাময়িজিস সাহাবা, ৮/২৩৫, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৯৫)
এই ধর্মীয় ভিত্তি নারীদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করে।
প্রথম যুগে স্বাস্থ্যসেবায় নারীদের ভূমিকা
মুসলিম নারীরা চিকিৎসার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন—নার্সিং, শল্যচিকিৎসা, ওষুধ তৈরি এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায়। এখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ও ব্যক্তিত্ব তুলে ধরা হলো:
রুফায়দা আল-আসলামিয়া (মৃ. ৬৩৪ খ্রি.): রুফায়দা বদর, খন্দক, ও খায়বারের যুদ্ধে অংশ নিয়ে আহত সাহাবিদের চিকিৎসা করেন। নবীজির নির্দেশে তিনি সাদ বিন মুআজ (রা.)-এর বাহু থেকে তির বের করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪০৭৬)
তাঁর তাঁবু মদিনার মসজিদে নববিতে স্থাপিত হয়, যেখানে তিনি অন্য নারীদের নার্সিং ও প্রাথমিক চিকিৎসা শেখান। রুফায়দা (রা.) যুদ্ধের গনিমত থেকে অংশ পেতেন, যা ছিল তাঁর অবদানের স্বীকৃতি। (আল-মাসরি, সাহাবিয়াত হাওলা আল-রাসুল, পৃ. ১২৮, কায়রো: দারুল কুতুব, ২০০৫)
জয়নাব চোখের রোগের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি স্থানীয় মলম তৈরি করে রোগীদের সেবা করতেন। আবু ফারাজ আল-ইসফাহানি (৮৯৭-৯৬৭ খ্রি.) তাঁর কাজের প্রশংসায় কবিতা লিখেছেন।
আল-শিফা বিনত আবদুল্লাহ (মৃ. ৬৪১ খ্রি.): আল-শিফা চর্মরোগ ও চোখের রোগের চিকিৎসায় দক্ষ ছিলেন। তিনি হাতে তৈরি মলম ব্যবহার করে ত্বকের ক্ষত সারাতেন। তাঁর পিঁপড়ার কামড়ের প্রতিরোধী চিকিৎসা নবীজি অনুমোদন করেন এবং তাঁকে অন্য নারীদের শেখানোর নির্দেশ দেন। খলিফা উমর বিন খাত্তাব (রা.) তাঁকে মদিনার বাজারে হিসবা (নিয়ন্ত্রক) পদে নিয়োগ করেন, যা ছিল ইসলামি ইতিহাসে নারীদের জন্য প্রথম সরকারি পদ। (হালাবি, আল-মায়্যার আল-নিসা ফিল-হাদিস, পৃ. ৮৯, বৈরুত: দারুল ফিকর, ২০০৪)
নুসায়বা বিনত হারিস (মৃ. ৬৮০ খ্রি.): নুসায়বা নবীজির সময়ে শিশু সুন্নতে খতনা করতেন এবং সাতটি যুদ্ধে আহতদের সেবা করেন। তিনি নবীজি (সা.)-এর কন্যা জয়নাব (রা.)-এর মৃতদেহ প্রস্তুত করেন। তার ৪০টির বেশি হাদিস সহিহ বুখারি ও মুসলিমে সংকলিত হয়েছে। (ইবনে হাজার, আল-ইসাবা, ৮/১৮৭)
জয়নাব বিনত বানি আওদ (৭ম শতাব্দী): জয়নাব চোখের রোগের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি স্থানীয় মলম তৈরি করে রোগীদের সেবা করতেন। আবু ফারাজ আল-ইসফাহানি (৮৯৭-৯৬৭ খ্রি.) তাঁর কাজের প্রশংসায় কবিতা লিখেছেন। (আল-ইসফাহানি, আল-আগানি, ২১/১৪৫, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৬০)
ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম নারী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নার্সিং, শল্যচিকিৎসা, ওষুধ তৈরি, এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁদের অবদান আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার জন্য অনুপ্রেরণা। ভবিষ্যতে এই নারীদের ওপর আরও গবেষণা প্রয়োজন।
(মুসলিম হেরিটেজ ডটকম অবলম্বনে)