আরব-ইসলামি ঐতিহ্য এক বিশাল ভাণ্ডার। এখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য আর ইতিহাসের অগণিত পাণ্ডুলিপি ধুলোয় ঢাকা পড়ে আছে। যেসব গ্রন্থ প্রায় হারিয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল, তার অন্যতম একটি হলো আমির উসামা ইবনে মুনকিজ আল-কিনানি আশ-শাইজারি (মৃ. ৫৮৪ হি.) রচিত আখবারুন নিসা (নারীর কথকতা) নামের বিরল গ্রন্থটি। এই বইটি কেবল একটি প্রকাশনা নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও একাডেমিক জগতে একটি বড় ঘটনা।
ইরাকি গবেষক ড. রশিদ আল-খাইয়ুন এই দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি সমকালীন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য-সম্পাদক হিসেবে পরিচিত। বইটি প্রকাশ করেছে সৌদি আরবের কিং ফয়সাল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, তাদের বিখ্যাত ‘তাহকিকুত তুরাস’ সিরিজের ৫২তম খণ্ড হিসেবে।
মাঝারি আকারের প্রায় সাতশো পৃষ্ঠার এই সংস্করণে রয়েছে বিস্তারিত টীকা-ভাষ্য, সূচিপত্র এবং একটি বিশাল ভূমিকা, যা গ্রন্থের মূল্য ও গুরুত্বকে নতুন করে তুলে ধরেছে।
উসামার পদ্ধতি একেবারেই ব্যতিক্রমী। প্রতিটি অধ্যায় শুরু হয় কোরআনের একটি আয়াত দিয়ে, তারপর দু-তিন বাক্যের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা, তারপর সংশ্লিষ্ট আলোচনা ও কবিতা।
হারানো ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কার
এই প্রকাশনার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো, গ্রন্থটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রায় অজ্ঞাত বা অর্ধ-অজ্ঞাত ছিল। পাণ্ডুলিপির শুরু ও কিছু অধ্যায় হারিয়ে যাওয়ায় পুরোনো ও নতুন কোনো গ্রন্থ-তালিকায় এর উল্লেখ মেলা ভার।
ড. খাইয়ুন অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভাষাতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন যে গ্রন্থটির রচয়িতা স্বয়ং আমির উসামা ইবনে মুনকিজ—যাঁকে ইমাম জাহাবি ‘ইসলামের বীর যোদ্ধা ও শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম’ বলে অভিহিত করেছেন। (জাহাবি, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১২/৫৬৭-৫৭৩, দারুল কুতুবিল আরাবি, বৈরুত, ১৯৮৫)
পাণ্ডুলিপিটির খোঁজের গল্প যেন কোনো রোমাঞ্চকর উপন্যাস। বড় বড় লাইব্রেরি—জাহিরিয়া, আজহারিয়া, খেদিভিয়া, বার্লিন, লাইডেন, প্যারিস—কোথাও এর নামগন্ধ ছিল না। অবশেষে আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান, এক ব্যক্তিগত সংগ্রহে মিলল একমাত্র পরিচিত পাণ্ডুলিপি। সেটি এখন কিং ফয়সাল সেন্টারে সংরক্ষিত রয়েছে।
পাণ্ডুলিপিটি তুলনামূলকভাবে পরবর্তীকালের (সম্ভবত দশম-একাদশ হিজরি শতাব্দী), কিন্তু ভাষা, শৈলী, ঘটনা ও নামের বর্ণনা ষষ্ঠ হিজরি শতাব্দীর সঙ্গে পুরোপুরি মিল আছে। ড. খাইয়ুন কিতাবুল ইতিবার ও আল-লুমা ফি আখবারি বনি সুলাইম-এর মতো উসামার অন্যান্য গ্রন্থের সঙ্গে তুলনা করে এবং ইবনুল জাওযি, ইবনে আসাকিরের সমকালীন রচনার সঙ্গে মিলিয়ে নিশ্চিত করেছেন যে এটিই মূল আখবারুন নিসা গ্রন্থ।
যোদ্ধা-কবি আমির উসামা
উসামা ইবন মুনকিজকে বোঝার আগে আখবারুন নিসা বোঝা মুশকিল। ৪৮৮ হিজরিতে সিরিয়ার শাইজারে জন্ম নেওয়া এই লেখক ছিলেন একই সঙ্গে তলোয়ারবাজ, কবি, রাষ্ট্রনায়ক ও সাহিত্যিক। ক্রুসেড যুগে তিনি দামেস্ক, কায়রো, মসুলের রাজদরবারে বিচরণ করেছেন। বিখ্যাত সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবির বন্ধু ছিলেন তিনি। ইবনে খাল্লিকান তাঁকে ‘সাহিত্য ও দূরদর্শিতা উভয় ক্ষেত্রেই যুগের বিরল প্রতিভা’ বলে উল্লেখ করেছেন। (ইবনে খাল্লিকান, ওয়াফায়াতুল আয়ান, ১/ ১৭৮, দারু সাদির, বৈরুত, ১৯৭৭)
তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ কিতাবুল ইতিবার বিশ্ববিখ্যাত। আখবারুন নিসা সেই ধারারই একটি বিশেষ রচনা—যেখানে নারীকে তিনি দেখিয়েছেন মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা, কবি, মুজাহিদা, রাজনীতিক হিসেবে।
গ্রন্থের অনন্য পদ্ধতি
পুরোনো আরবি সাহিত্যে নারীবিষয়ক গ্রন্থ কম নয়, কিন্তু উসামার পদ্ধতি একেবারেই ব্যতিক্রমী। প্রতিটি অধ্যায় শুরু হয় কোরআনের একটি আয়াত দিয়ে, তারপর দু-তিন বাক্যের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা, তারপর সংশ্লিষ্ট আলোচনা ও কবিতা। উদাহরণ: ‘মায়ের অধ্যায়’-এ শুরু হয় আয়াত দিয়ে—আর আমি মানুষকে তার মাতাপিতার ব্যাপারে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। (সুরা লুকমান, আয়াত: ১৪)
তারপর লেখক বলেন, আল্লাহ মা-বাবার সঙ্গে সদয় আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন, আর মায়ের গর্ভধারণ ও প্রসবের কষ্টকে তাঁর অধিকার দ্বিগুণ করার কারণ বানিয়েছেন। এরপর আসে সাহাবি নারীদের মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসার গল্প, আরবদের উক্তি ও মায়েদের জন্য রচিত কবিতা।
এভাবেই চলে বোন, স্ত্রী, কন্যা, জাহেলি ও ইসলামি যুগের বিখ্যাত নারী, শায়েরা, আলেমা, রাজনীতিক ও মুজাহিদা নারীদের অধ্যায়। উল্লেখযোগ্য যে লেখক শুধু মুসলিম নারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি; আহলে কিতাব ও এমনকি মুশরিক নারীদের গল্পও এনেছেন—যদি তাতে শিক্ষা বা বাগ্মিতার মতো কোনো বিষয় থাকে।
নারীর বহুমুখী চিত্র
গ্রন্থটি দুটি বড় ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে পারিবারিক সম্পর্কের নারী: মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা। মায়ের অধ্যায়ে এসেছে সাহাবিয়াতের মাতৃভক্তির গল্প, মায়েদের সন্তানদের জন্য নসিহত। কন্যা অধ্যায়ে রাসূল (সা.)-এর হাদিস: “যে ব্যক্তি তিনজন মেয়েকে—হোক দাসী বা নিজের কন্যা—স্নেহ-যত্নে লালন-পালন করে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, কিংবা তারা তার জীবদ্দশায়ই মারা যায়—সে নিশ্চয় জান্নাতের অধিকারী হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৩৬৮)
দ্বিতীয় ভাগে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ নারী: লায়লা আল-আখইলিয়্যাহ, খানসা, রাবাব বিনত উমর, উযযা বিনত আবিহের মতো কবি; উম্মুদ দারদা, আয়েশা বিনত সা’দের মতো আলেমা; শাজারাতুদ দুর, যুবাইদা, আন্দালুসের আমিরপত্নী উম্মু খালিদের মতো রাজনীতিক; এমনকি ক্রুসেডের সময় শত্রুর আক্রমণ থেকে গ্রাম বাঁচানো সাধারণ নারীর গল্পও স্থান পেয়েছে।
ইবনুল জাওযির সঙ্গে পার্থক্য
অনেকে আখবারুন নিসা-কে ইবনুল জাওযির একই নামের গ্রন্থের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু ড. খাইয়ুন স্পষ্ট করেছেন, পার্থক্য আকাশ-পাতাল। ইবনুল জাওযি লিখেছেন ওয়াজ-নসিহতের দৃষ্টিকোণ থেকে, দুনিয়ার প্রতি বিতৃষ্ণা জাগানোই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। আর উসামা লিখেছেন সাহিত্যিক-মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, নারীর সমাজ গঠনে অবদান তুলে ধরতে। একজনের কাছে প্রধান হাদিস হাদিস-আসার, অন্যজনের কাছে কবিতা ও সাহিত্য।
লেখক শুধু মুসলিম নারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি; আহলে কিতাব ও এমনকি মুশরিক নারীদের গল্পও এনেছেন—যদি তাতে শিক্ষা বা বাগ্মিতার মতো কোনো বিষয় থাকে।
ঐতিহাসিক মূল্য
এই গ্রন্থ ষষ্ঠ হিজরি শতাব্দীর আরব-ইসলামি সমাজে নারীর প্রকৃত অবস্থানের দলিল। দেখা যায়, নারী কেবল ঘরে বন্দি ছিলেন না; তারা ছিলেন কবি, আলেমা, যোদ্ধা, শাসকের উপদেষ্টা, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারী। কিছু ঘটনা এমন আছে যা বড় বড় ইতিহাস গ্রন্থেও পাওয়া যায় না।
বিশ্লেষণের বিশেষত্ব
ড. রশিদ আল-খাইয়ুনের পরিশ্রম অবিস্মরণীয়। তিনি ভাষা, শৈলী, ইতিহাসের অকাট্য প্রমাণ দিয়ে রচয়িতার পরিচয় নিশ্চিত করেছেন, কঠিন শব্দের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, নাম-উপনাম সংশোধন করেছেন, বিস্তারিত সূচিপত্র তৈরি করেছেন এবং একটি বিশাল ভূমিকা লিখেছেন। বছরের পর বছর লেগেছে এই কাজে। তাঁর কাছে এটা ছিল এক ‘ইলমি জিহাদ’।
আখবারুন নিসা আজকের দিনে এসে আমাদের সামনে তুলে ধরছে এক সেকালের ইসলামি সমাজের প্রাণবন্ত নারীচিত্র—যে নারী ছিলেন সভ্যতা গঠনের অবিচ্ছেদ্য অংশীদার। এই গ্রন্থ প্রমাণ করে, আমাদের পূর্বসূরিরা নারীর মর্যাদা ও অবদান ভালো করেই উপলব্ধি করতেন এবং তা সযত্নে লিপিবদ্ধ করে গেছেন।