ইখওয়ানুস সাফা: জ্ঞানচর্চার গুপ্ত সংগঠন
ইলুমিনাতি, ফ্রি ম্যাসন বা নাইট টেম্পলার ইত্যাদি খ্রিষ্টান ধর্মের ইতিহাসে এ রকম গুপ্ত সংগঠনের কথা আমরা জানি। কিন্তু মুসলিম ইতিহাসেও যে এ রকম জ্ঞানতাত্ত্বিক গুপ্ত সংগঠন ছিল, সেটা আমাদের অনেকেরই অজানা। এমনই এক গুপ্ত সংগঠনের নাম ইখওয়ানুস সাফা।
কীভাবে শুরু
সময়টা দশম খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিক। বাগদাদে আব্বাসি খেলাফত তখন অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। দিকে দিকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে নতুন নতুন মুসলিম সাম্রাজ্য ও বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদ। ধারণা করা হয়, মুসলিম রাজনৈতিক চিন্তার এমন অস্থির সময়ে ৯৮০-৮২ সালের দিকে গঠিত হয় ইখওয়ানুস সাফা নামের একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক গুপ্ত সংগঠন।
ইখওয়ানুস সাফার সদস্যদের বিশ্বাস ছিল, তৎকালীন ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বিধিবিধান ও চিন্তা অনেকাংশে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। তাই ধর্ম, রাজনীতি ও প্রজ্ঞার মধ্যে বিশুদ্ধ গবেষণা ও সামঞ্জস্য আনা প্রয়োজন। ধর্ম সাধারণ মানুষের জন্য। তবে ধর্মের বাহ্যিক চরিত্রের নেপথ্যে যে দার্শনিক ও নিগূঢ় সত্য লুকিয়ে থাকে, তা কেবল জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান মানুষই বুঝতে পারেন। এ জন্য প্রয়োজন গভীর অধ্যবসায়, জ্ঞানসাধনা, গবেষণায় পারদর্শী ও সংগঠিত একদল প্রজ্ঞাবান লোকের।
শাসকগোষ্ঠী থেকে নিজেদের মতাদর্শ গোপন রাখতে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন শহরের প্রাজ্ঞ একদল লোক বেছে নিয়েছিলেন গুপ্ত সংগঠনের পথ। যাতে রাজনীতি ও ধর্মীয় উগ্রবাদের আড়ালে তাঁরা মুক্ত জ্ঞানচর্চা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
কিন্তু ওই সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ইসলামের নামে বিভিন্ন কট্টরপন্থী ধর্মীয় মতবাদ উত্থানের ফলে এই দর্শন ও জ্ঞানতাত্ত্বিক কার্যক্রম প্রকাশ্যে পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। তাই ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ ও শাসকগোষ্ঠী থেকে নিজেদের মতাদর্শ গোপন রাখতে বসরাসহ তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন শহরের প্রাজ্ঞ একদল লোক বেছে নিয়েছিলেন গুপ্ত সংগঠনের পথ। যাতে রাজনীতি ও ধর্মীয় উগ্রবাদের আড়ালে তাঁরা তাঁদের মুক্ত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
কিছু পরিচিত মুখ
ইখওয়ানুস সাফার সদস্য কারা ছিলেন, এখন পর্যন্ত তাঁদের সঠিক ও প্রমাণযোগ্য নাম জানা যায়নি। যুগের পর যুগ ধরে তাঁরা লোকচক্ষুর অন্তরালে জ্ঞানচর্চা করে গেছেন। তবে তাঁদের সমসাময়িক একজন লেখক আবু হাইয়ান আল তাওহিদি (৯২৩-১০২৩ খ্রি.) তাঁর কিতাবুল ইমতিয়া ওয়াল মুয়নাসাত-এ এই গুপ্ত সংগঠনের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন।
তাঁদের মধ্যে আবু সোলাইমান আল বুশতি অন্যতম, যিনি ভূগোলবিদ আল মুকাদ্দাসি বা আল মাকদিসি নামে ইতিহাসে পরিচিত। এ ছাড়া আছেন আলী ইবনে হারুন আল জানজানি, মুহম্মদ আল নাহরাজুরি, আল আওফি, জায়েদ ইবনে রিফা, আবু আহমদ প্রমুখ।
তাদের রচনা ও মতাদর্শে মু’তাজিলা মতবাদের প্রভাব লক্ষ করা গেলেও তারা মূলত নির্দিষ্ট কোনো মতবাদে বিশ্বাসী ছিল না, বরং তারা নিজেদের ধর্মীয় মতাদর্শের ঊর্ধ্বে মনে করতেন।
ইখয়ানুস সাফা নিয়ে লেখা বই রাসায়েলে ইখওয়ানুস সাফার একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘জেনে রাখুন, আমাদের মধ্যে রাজা, রাজপুত্র, খলিফা, সুলতান, মন্ত্রী, প্রশাসক, রাজস্ব কর্মকর্তা, কোষাধ্যক্ষ, চাকরিজীবী, অভিজাত, রাজার অমাত্য এবং সেনা কর্মকর্তা আছেন। সেই সঙ্গে আছেন ব্যবসায়ী, শিল্পী, কৃষক ও নির্মাতা। সব ধরনের গুণের অধিকারী থেকে জানা–অজানা জ্ঞানের সব শাখার পণ্ডিতেরা রয়েছেন আমাদের সঙ্গে।’
রচনা সংকলন
ইখওয়ানুস সাফার সবচেয়ে বড় অবদান তাদের রচিত গ্রন্থ রাসায়েলে ইখওয়ানুস সাফা বা ইখওয়ানুস সাফার গ্রন্থপঞ্জি। এ গ্রন্থে মোট ৫২টি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি যুক্তিবিদ্যার সমস্যাবলি নিয়ে, ১০টি অধিবিদ্যা নিয়ে, ১১টি সুফিবাদ ও জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে, ১৭টি প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, আবহাওয়াতত্ত্ব, ভূগোল প্রভৃতি নিয়ে আলোচিত হয়েছে। বিশ্লেষণ করা হয়েছে নীতিবিদ্যা, সংখ্যাতত্ত্ব, মনোবিদ্যা ও পরকাল নিয়ে।
মূলত দশম শতক পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিকাশ এই সংকলনে বর্ণনা করা হয়েছে। এ জন্য একে দর্শন ও বিজ্ঞানের বিশ্বকোষও বলা হয়। ২০২১ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস ইখওয়ানুস সাফার পরিপূর্ণ রাসায়েল দ্য ইখওয়ানুস সাফা অ্যান্ড দেয়ার রাসায়েল: অ্যান ইন্ট্রোডাকশন নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে।
ইখওয়ানুস সাফা পদার্থবিদ্যা ও অধ্যাত্মবিদ্যা দিয়ে ইসলামের বিভিন্ন অতীন্দ্রিয় বিষয় বিশ্লেষণ করতেন। ধর্মকে তারা ব্যাখ্যা করত যুক্তিবিদ্যা ও নীতিবিদ্যার আবহে।
মতবাদ নিয়ে বিতর্ক
ইখওয়ানুস সাফা পদার্থবিদ্যা ও অধ্যাত্মবিদ্যা দিয়ে ইসলামের বিভিন্ন অতীন্দ্রিয় বিষয় বিশ্লেষণ করতেন। তেমনি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যামিতি দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করত সৃষ্টিতত্ত্ব ও মহাবিশ্ব। ধর্মকে তারা ব্যাখ্যা করত যুক্তিবিদ্যা ও নীতিবিদ্যার আবহে।
এ কারণে কেউ তাদের বলেছেন মু’তাজিলা, আবার কেউ বলেছেন ইসমাইলি শিয়া, কেউ কেউ তাদের আখ্যায়িত করেছেন বাতেনি শিয়া বলে। তবে তাদের রচনা ও মতাদর্শে মু’তাজিলা মতবাদের প্রভাব লক্ষ করা গেলেও তারা মূলত নির্দিষ্ট কোনো মতবাদে বিশ্বাসী ছিল না, বরং তারা নিজেদের ধর্মীয় মতাদর্শের ঊর্ধ্বে মনে করতেন।
অবশেষে কী হলো
বাগদাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ফাতেমিদের ভেতরেই বিভাজনের টানাপোড়েন—এসব প্রতিবন্ধকতার কারণে ইখওয়ানুস সাফার প্রভাব খুব বেশি অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি। একে তো গোপন সংগঠন, অন্যদিকে প্রচুর অধ্যবসায়ের ভেতর দিয়ে টিকে থাকার মানসিকতাও হারিয়ে ফেলে সদস্যদের অনেকে।
এ ছাড়া ধর্মতাত্ত্বিক মতবিরোধমূলক আলোচনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে দার্শনিক জ্ঞানচর্চা উপেক্ষিত হতে থাকে। ফলে ধীরে ধীরে এ গুপ্ত সংগঠনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
ইখওয়ানুস সাফা ঠিক কত দিন তাদের কার্যক্রম চালিয়ে নিয়েছিল, সে ব্যাপারে কেউ কোনো মন্তব্য করতে পারেনি। আবার সত্যিই তাদের কার্যক্রম নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল, নাকি তারা সত্যিকার অর্থেই আরও গোপন হয়ে গিয়েছিল লোকচক্ষু থেকে, সেটা নিয়েও রয়ে গেছে ধোঁয়াশা।