তারবিয়ার দিন

মিনার রাস্তাছবি: ফেরদৌস ফয়সাল

হজের মূল পর্ব বা কাজ শুরু হয় ৮ জিলহজ থেকে। তারিখটিকে ‘ইয়াওমুত তারবিয়া’বা তারবিয়ার দিন বলা হয়। তবে দিনে বাড়তি বা বিশেষ কোনো আমল নেই মিনায় অবস্থান করে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা ছাড়া।

১৪৪৪ হিজরির ৮ জিলহজ ছিল ২০২৩ সালের ২৬ জুন, যদিও আমরা আগের দিন রাতে মানে ২৫ জুন দিবাগত রাতে মিনায় চলে আসি। রাতটা ভালোভাবে কেটে যায়। ভোরে উঠে ফজরের সালাত তাঁবুর মধ্যেই জামাত করে আদায় করি আমরা। মিনা থেকে কিবলা উত্তর-পশ্চিমে, তবে সামান্য উত্তরমুখী হতে হয়।

ফজরের সালাতের পরই জানতে পারি এক বিপত্তির কথা। হাজিরা সারা রাত ধরেই মিনায় এসেছেন। আমরা যেই তাঁবুতে আছি, সেটা আরও অনেককে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁরা মাঝরাতে এসে আর জায়গা পাননি। এই একেক তাঁবুতে ঠিকঠাকমতো বিছানা ফেললে ৩০০ জনের সংকুলান হয়। মোয়াল্লেমের লোকজন গাদাগাদি করে বিছানা ফেলেছে ৩১০-৩২০ জনের। আর ৩৩০-৩৩৫জন হাজিকে একই তাঁবুর ভেতরে থাকার হাত বন্ধনী দিয়েছে। ফলে যাঁরা পরে এসেছেন, তাঁরা জায়গা না পেয়ে কেউ সারা রাত বাইরে বসেছিলেন, কেউ বা অন্যত্র চেষ্টা করেছেন কোনোভাবে থাকার। সংশ্লিষ্ট গাইডরা ছোটাছুটি করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। মোয়াল্লেমের প্রতিনিধিরা পাত্তাই দিতে চাননি। এটা খুবই বেদনাদায়ক বিষয়। হাজিদের এভাবে কষ্ট দেওয়া অনেক মুয়াল্লেম বা কোম্পানির কাছে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

সকালে নাশতা এলো আরব রুটি খবুজ, ছোলার ডাল ও ডিম। গাইড আক্তার হোসেন ভাই বেশ আগে থেকে অবস্থান নিয়ে প্রতিবেলায় দ্রুত খাবার এনেছেন। একাজে তাঁকে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সহায়তা করেছেন আজম, তানজীর ও কামাল।

আমাদের তাঁবুর পাশাপাশি ছিল পাকিস্তানি হাজিদের তাঁবু। সাধারণত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার হাজিদের একটা অভিন্ন এলাকায় রাখা হয়—একই মক্তবের অধীনে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশি হাজিরা ৭এ, ৭বি ও ৮ নম্বর মক্তবের অধীনে ছিলেন। তাবুগুচ্ছগুলো সব ৫৬ নম্বর রাস্তায়। একই রাস্তার অপর পাশে ১২ নম্বর তাঁবুতে বাংলাদেশ হজ অফিসের অবস্থান। মিনায় আসার আগেই হজ অফিস থেকে মিনা ও আরাফার মানচিত্র সরবরাহ করা হয়েছিল। আর এখানেও হজ অফিস থেকে দেওয়া হয়েছে। এই হজ অফিসে ছিল মেডিকেল বুথ যেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ছিল হাজি হারানোর খবর দেওয়া ও নেওয়ার ব্যবস্থা। সর্বোপরি বাংলাদেশি হাজিদের যে কোনো সমস্যার বিষয়ে এখানে যোগাযোগ করার সুযোগ ছিল। ওখানে মিনা ও আরাফার মানচিত্র এবং হজ গাইড সরবরাহ করা হচ্ছিল। আমাদের সঙ্গে প্রথম আলোর হজ গাইড । আমার সহধর্মিণী আবার তাঁবুর ভেতর সেগুলোর কয়েক কপি বিতরণ করলেন।

দুপুরে খাবার এলো ভাত ও মুরগি। রান্না বেশ ভালো ছিল। পরিমাণেও যথেষ্ট। তাঁবুর বাইরে একটু পরপর ফ্রিজে ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে দ্রুতই পানি শেষ হয়ে যায়। একেকজন কয়েকটা করে বোতল নিয়ে আসে। আবার পানি আসতে সময় লাগে।

টয়লেটের ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। সবচেয়ে বিব্রতকর ব্যাপার হলো একপাশে মহিলাদের, আরেকপাশে পুরুষদের টয়লেটের সারি। ওখানে যথেষ্ট পর্দা বা আড়াল করার ব্যবস্থা নেই। অজুর জায়গাও সীমিত। আমাদের সৌভাগ্য যে ৫৬ নম্বর রাস্তার ওপারে বা পশ্চিমদিকে বাংলাদেশ হজ অফিস পেরিয়ে গেলেই পায়ে হাঁটার পথ বা ১ নম্বর পেডেস্ট্রিয়ান রোড যা টিনশেডের রাস্তা বলে বাংলাদেশিদের কাছে পরিচিত। এই রাস্তার ধারে একটু পরপর অনেকগুলো টয়লেট। অজুখানার পাশাপাশি দুতিনটা করে গোসলখানাও আছে। আমাদের তাঁবু থেকে কয়েক মিনিট হাঁটলেই এই রাস্তায় এসে টয়লেট ব্যবহার করা যায়। আমরা অনেকে সেটাই করেছি। আমাদের মা-বোনেরাও অনেক তা করেছেন। ফলে তাবুগুচ্ছের টয়লেটের ভিড় এড়ানো গেছে।

মিনায় চপ্পল নিয়ে ছোটখাটো বিপত্তি ঘটে থাকে। ঘুরে ফিরে কয়েক ধরনের দুই ফিতায়ালা চপ্পল সবাই পায়ে দিয়ে থাকে। ফলে একজনেরটা ভুলক্রমে আরেকজনের পায়ে চলে যেতে পারে। আমি আমারটার ফিতের গায়ে অমোচনীয় কালি নিয়ে মক্তব-৮ লিখে রেখেছিলাম।

দুই

মাগরিবের সালাতের পর খবর এল যে ইশার সালাত পরে আরাফাতের উদ্দেশে রওনা দিতে হবে। এখানেও সেই সুন্নাহর খেলাফ! দলের দুয়েকজন বেঁকে বসেছিলেন যে পরদিন ফজরের সালাত আদায় না করে যাবেন না। তবে না গিয়ে পারেননি। আসলে যেভাবে সৌদি আরব সরকার নিয়মকানুন ঠিক করে দিয়েছে, সেভাবেই তা পরিপালন করতে হয়। তারপরও লাখ লাখ হাজির মধ্যে কয়েকশ হয়তো একটু ফাঁকফোকর গলে অন্যথা করে, যা ধরা যায় না।

রাতের খাবার সেরে আমরা দলে দলে বেড়িয়ে পড়লাম তালবিয়া পড়তে পড়তে। ১ নম্বর পেডেস্ট্রিয়ান রোড ধরে পিঠে যার যার ব্যাগ চাপিয়ে হাঁটা দিলাম মিনার দুই নম্বর রেল স্টেশনের উদ্দেশে। ভূমি থেকে অন্তত পাঁচ-ছয় তলা ওপরে চৈনিক কারিগরি সহায়তায় স্থাপিত আল মাশহায়ের আল মুগাদ্দাসা মেট্রো লাইন। শুধু হজের দিনগুলোতে এক সপ্তাহ এতে ট্রেন চলে।

তিন-চারটা র‌্যাম্প বেয়ে তারপর অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত যেতে দীর্ঘ সারি। এখানেই প্রায় দেড় ঘণ্টার বেশি লেগে গেল। ট্রেনেও বেশ গাদাগাদি করেই দাঁড়াতে হলো। তবে আরাফার দুই নম্বর স্টেশনে গিয়ে নামলাম মাত্র ১৫ মিনিটে। ট্রেন থেকে নেমে আবার একাধিক র‌্যাম্প বেয়ে ও সিঁড়ি ভেঙে গিয়ে নামলাম আরাফার ময়দানে। তখন রাত প্রায় ১২টা।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন