নবীজি (সা.)–এর সঙ্গে ফেরেশতা জিবরাইলের বিভিন্ন সাক্ষাৎ

ছবি: রয়টার্স

মহানবী (সা.)-এর নবীজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ওহিপ্রাপ্তি। আল্লাহ তাঁর কোরআন ও নির্দেশনা ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে আসমান থেকে প্রেরণ করতেন। তাই নবীজি কতবার এবং কীভাবে জিবরাইলকে দেখেছেন, এই প্রশ্ন ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।

কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে জানা যায়, জিবরাইলকে নবীজি তাঁর সৃষ্ট রূপে মাত্র দুবার এবং মানুষের রূপে অসংখ্যবার দেখেছেন।

মাথা তুলে তাকিয়ে দেখেন, হেরা গুহায় যিনি এসেছিলেন, সেই ফেরেশতা জিবরাইল আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে এক বিশাল আসনে বসে আছেন।

প্রথম সাক্ষাৎ: ফাতরাতুল ওহি

প্রথম ওহি নাজিলের পর কিছুদিন ওহির ধারা বন্ধ ছিল, যা ‘ফাতরাতুল ওহি’ নামে পরিচিত। এ সময় রাসুল (সা.) গভীর চিন্তা ও উৎকণ্ঠায় দিন কাটাতেন। তিনি ভাবছিলেন, এরপর কী হবে। এই বিরতি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুওয়তের দায়িত্ব গ্রহণ ও দাওয়াতের জন্য প্রস্তুতির একটি সময়।

একদিন তিনি আকাশ থেকে একটি শব্দ শুনতে পান। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখেন, হেরা গুহায় যিনি এসেছিলেন, সেই ফেরেশতা জিবরাইল আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে এক বিশাল আসনে বসে আছেন। তাঁর অপরূপ রূপ দিগন্তজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি তাঁকে দিগন্তজুড়ে দেখেছি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬১)

আরও পড়ুন

এ দৃশ্য দেখে তিনি আতঙ্কিত হয়ে বাড়ি ফিরে বললেন, ‘আমাকে বস্ত্র দিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে বস্ত্র দিয়ে ঢেকে দাও।’ তখন মহান আল্লাহ নাজিল করলেন, ‘হে বস্ত্রাবৃত, উঠে সতর্ক করো। তোমার রবের মহিমা ঘোষণা করো। তোমার পোশাক পবিত্র রাখো। আর মূর্তিপূজা থেকে দূরে থাকো।’ (সুরা মুদ্দাস্‌সির, আয়াত: ১-৫)

এভাবে নবুওয়তের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।

দ্বিতীয় সাক্ষাৎ: মিরাজের রাত

নবীজীবনের সবচেয়ে মহিমান্বিত অভিজ্ঞতা ছিল মিরাজ। এই রাতে তাঁকে মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে আসমানের বিভিন্ন স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সফরের একপর্যায়ে তিনি ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-কে তাঁর মূল সৃষ্ট রূপে দ্বিতীয়বার দেখেন।

কোরআন এ ঘটনার বর্ণনায় বলে, ‘তিনি তাঁকে আরেকবার দেখেছেন, ‘সিদরাতুল মুনতাহা’র নিকটে, যার কাছে রয়েছে জান্নাতুল মাওয়া। যখন বৃক্ষটি যা দিয়ে ঢাকা থাকার তা দিয়ে ঢাকা ছিল। তাঁর দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত হয়নি এবং সীমা অতিক্রম করেনি। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর রবের মহান নিদর্শনসমূহ দেখেছিলেন।’ (সুরা নাজম, আয়াত: ১৩-১৮)

নবীজি জিবরাইলকে তাঁর সৃষ্টরূপে মাত্র দুইবার দেখেছেন।
সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩২৩৪

ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) জিবরাইলকে তাঁর মূল রূপে দুবার দেখেছেন। তাঁর ৬০০ ডানা ছিল, যা আসমানকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৪)

আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবীজি জিবরাইলকে তাঁর সৃষ্টরূপে মাত্র দুইবার দেখেছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩২৩৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৭)

আরও পড়ুন

মানুষের রূপে জিবরাইলের আগমন

জিবরাইল (আ.)-কে নবীজি তাঁর মূল রূপে মাত্র দুবার দেখলেও মানুষের রূপে তিনি বহুবার এসেছেন। সবচেয়ে বেশি তিনি সাহাবি দিহইয়া কালবি (রা.)-এর রূপে আসতেন, যিনি ছিলেন মদিনার একজন সুন্দর অবয়বের সাহাবি। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘জিবরাইল সাধারণত দিহইয়া কালবির রূপে আসতেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৯৮৮)

কখনো কখনো তিনি অপরিচিত মানুষের রূপেও আসতেন। ওমর (রা.) বর্ণনা করেন: ‘একদিন আমরা রাসুলের সঙ্গে বসে ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি আমাদের সামনে হাজির হলেন। তাঁর পোশাক ছিল ঝকঝকে সাদা, চুল ছিল গাঢ় কালো। তাঁর শরীরে ভ্রমণের কোনো চিহ্ন ছিল না, অথচ আমরা কেউ তাঁকে চিনতাম না।

একদিন আমরা রাসুলের সঙ্গে বসে ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি আমাদের সামনে হাজির হলেন। তাঁর পোশাক ছিল ঝকঝকে সাদা, চুল ছিল গাঢ় কালো।

তিনি রাসুলের সামনে বসে তাঁর হাঁটু তাঁর হাঁটুর সঙ্গে ঠেকিয়ে, হাত তাঁর ঊরুর ওপর রেখে জিজ্ঞাসা করলেন: ‘ইসলাম কী? ইমান কী? ইহসান কী? কিয়ামত কখন হবে?’ আল্লাহর রাসুল উত্তর দেওয়ার পর তিনি চলে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর নবীজি বললেন, ‘ওমর, জানো, এই প্রশ্নকারী কে ছিলেন?’ আমি বললাম, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভালো জানেন।’ তিনি বললেন, ‘তিনি ছিলেন জিবরাইল। তিনি এসেছিলেন তোমাদের দ্বীন শেখাতে।’’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮)

রাসুল (সা.)-এর এই অভিজ্ঞতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে অদৃশ্য জগৎ ও আল্লাহর ফেরেশতারা বাস্তব সত্য। আমাদের জন্য সর্বোত্তম পথ হলো আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা এবং তাঁর কোরআন ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা। এটিই দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির পথ।

মাওলানা আজিজ আল কাউসার: খতিব, টোলারবাগ কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঢাকা।

আরও পড়ুন