রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যে স্ত্রীরা উদ্যোক্তা ছিলেন
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রথম স্ত্রী সাইয়িদা খাদিজা (রা.) যে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী তা আমরা সবাই মোটামুটি জানি। প্রশ্ন হলো, তিনি ছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আর কোনো স্ত্রী কি ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা ছিলেন?
নানা পরিস্থিতির বিবেচনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) ১১ বার, কোনো কোনো মতে ১৩ বার বিয়ে করেছিলেন। ২৫ বছর বয়সে প্রথম স্ত্রী হিসেবে রাসুলুল্লাহ (সা.) খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদকে বিয়ে করেন। ৬১৯ সালে খাদিজার মৃত্যুর পর জীবনের অবশিষ্ট বছরগুলোতে তিনি বাকি বিয়েগুলো করেছিলেন। এই স্ত্রীদের অনেকেই ছিলেন বিধবা, যুদ্ধে স্বামীহারা, স্বামী পরিত্যক্তা ও দুস্থ। স্কটিশ ইতিহাসবিদ (১৯৫৬) মন্টোগোমারি ওয়াট বলেছেন, ‘মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রায় সব বিয়েরই ছিল মিত্রতার সম্পর্ককে শক্তিশালী করার একটি রাজনৈতিক দিক। আর সেটি তার ভিত্তি গড়ে উঠেছিল আরব রীতির ওপর।’ (মুহাম্মদ ইন মাদিনা, ডব্লিউ মন্টোগোমারি ওয়াট, ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতের ডিজিটাল লাইব্রেরি, ক্ল্যারেন্ডন প্রেসে অক্সফোর্ড, পৃষ্ঠা: ২৮৭)
আরও বলা হয়েছে, ‘মুহাম্মদ (সা.)–এর কিছু বিয়ের উদ্দেশ্য ছিল বিধবাদের সহযোগিতা করা।’ (ইসলাম: দ্য স্ট্রেইট পাথ, জন এল এস্পোসিটো, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস)
এই স্ত্রীদের মধ্যে খাদিজা (রা.) ছাড়া আর কে কে ব্যবসায়ী ছিলেন, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ও বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায় না। সামান্য যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তা এ রকম:
চামড়ার গৃহস্থালি পণ্য বানাতেন সাওদা (রা.)
সাওদা (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দ্বিতীয় স্ত্রী। ৬২০ সাল মোতাবেক নবুয়তের দশম বছর রমজান মাসের শেষের দিকে তাঁদের বিয়ে হয়। সাওদা (রা.) মোট ১৩ বছর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সংসার করেছেন। হিজরি ১৯ মতান্তরে ২০–২২ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি মোট পাঁচটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।
ইবাদত-বন্দেগির প্রতি সাওদা (রা.)-র আগ্রহ ছিল বিস্ময়কর। তিনি নিজেই উপার্জন করতেন। তায়িফ থেকে প্রক্রিয়াজাত চামড়া এনে তা দিয়ে গৃহস্থালির বিভিন্ন পণ্য বানিয়ে বিক্রি করতেন সাওদা (রা.)। উপার্জিত অধিকাংশ অর্থই গরিব-অসহায়দের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। (প্রিয়তমা, সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর, নব প্রকাশ, পৃষ্ঠা: ১০১-১০২)
ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে তিনি একবার সাওদার কাছে হাদিয়া হিসেবে এক থলে দিরহাম পাঠালেন। দিরহামের থলে দেখে সাওদা সেবিকাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা কী?’ সেবিকা বললেন, ‘ওমর (রা.) আপনার জন্য এক হাজার দিরহাম হাদিয়া পাঠিয়েছেন।’ সাওদা বললেন, ‘এই দিরহামের থলে তো আমার কাছে খেজুরের থলের মতোই।’ অর্থাৎ এক থলে খেজুরের চেয়ে সেই থলের মূল্য তাঁর কাছে অতিরিক্ত কিছু ছিল না। তিনি সব দিরহাম গরিব-দুঃখীদের দান করে দিলেন। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ১০১)
হস্তশিল্পী জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)
জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সপ্তম স্ত্রী। পঞ্চম হিজরি সনের জিলকদ মাসে, মতান্তরে চতুর্থ হিজরিতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। (তাহজিবুল কামাল ফি আসমাইর রিজাল, জামালুদ্দিন মিজজি, ৫৩/১৮৪; আস-সিরাতুল হালাবিয়্যাহ, আলি ইবনে বুরহান হালাবি, ৩/৩২০)
২০ হিজরি সনে জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)-এর ইন্তেকাল হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) কাছ থেকে তিনি ১০-১১টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। (উম্মুল মুমিনিন, ড. ইয়াসির ক্বাদি, ভাষান্তর: আলী আহমাদ মাবরুর ও মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ, প্রচ্ছদ প্রকাশন, পৃষ্ঠা: ২৭৫)
জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)-এর বাবা ছিলেন জাহাশ ইবনে রাবাব। ইসলামপূর্ব যুগে ব্যবসার উদ্দেশ্যে তিনি মক্কায় আসেন এবং কুরাইশ নেতা আবদুল মুত্তালিবের সঙ্গে অংশীদারি কারবারে সম্পৃক্ত হন। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ২৭৫)
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার হাত সবচেয়ে বেশি দীর্ঘ, সবার আগে সে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।’ আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলের কথা শুনে আমরা একে অপরের হাত মেপে দেখলাম, কার হাত সবচেয়ে লম্বা! প্রকৃত অর্থে জয়নবের হাত দীর্ঘ ছিল। কারণ, হাতের দৈর্ঘ্য বলতে রাসুলুল্লাহ (সা.) দানশীলতা ও উদারতা বুঝিয়েছেন। জয়নব নিজ হাতে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে সদকা করতেন।’ (মুসলিম, হাদিস: ২,৪৫২)
আয়েশা আরেক জায়গায় বর্ণনা করেছেন, ‘জয়নব ছিলেন হস্তশিল্পে পারদর্শী নারী। নিজ হাতে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে আল্লাহর রাস্তায় দান করাতে তাঁর জুড়ি ছিল না।’ (আস-সিমতুস সামিন ফি মানাকিবি উম্মাহাতিল মুমিনিন, ইবনুল কাস, পৃষ্ঠা: ১২৮)
অনেক গবেষক বলেছেন, তিনি সরাসরি পণ্যও দান করে দিতেন। তাঁর দানশীলতার খ্যাতি ছিল। এ কারণে জনয়ব (রা.)–কে উম্মুল মাসাকিন বা অসহায়-দুস্থদের মা বলা হতো (সিয়ারু আলামিন নুবালা, জাহাবি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ২১২)। তাঁর দানশীলতার স্বীকৃতি দিয়ে আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘বিপুল দানশীলতার ক্ষেত্রে জয়নবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নারী আমি কখনো দেখিনি।’ (মুসলিম, হাদিস: ১,৮৯২)
ইতিহাসবিদ ও সিরাত রচয়িতারা জয়নব বিনতে জাহাশকে (রা.) হস্তশিল্পে পারদর্শী নারী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আরবিতে তাঁকে ‘সান্নাউল ইয়াদ’ বলা হতো। (উম্মুল মুমিনিন জয়নব বিনতে জাহাশ রাদিয়াল্লাহু আনহা, আমিনা উমর আল-খাররাত, ভাষান্তর: মাওলানা মাহমুদ সিদ্দিকী, দ্বীন পাবলিকেশন, পৃষ্ঠা: ৭২)
কোনো নারী যখন হস্তশিল্পের মাধ্যমে উপার্জন করেন, আরবি পরিভাষায় তাঁকে ‘সান্নাউল ইয়াদ’ বলা হয়। (লিসানুল আরব, ইবনে মানযুর, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা: ২০৯)
লেখক: মিরাজ রহমান