আহলে বাইতের পরিচয় এবং আমাদের কর্তব্য

ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়ায় প্রদর্শিত ক্যালিগ্রাফিক সীলমোহরে হুসাইন (রা.)–এর নামছবি: উইকিপিডিয়া

প্রতিদিন নামাজে বা নামাজের বাইরে আমরা দরুদ পাঠ করি। দরুদের মাধ্যমে রাসুল (সা.) ও তাঁর পরিবারবর্গের জন্য আল্লাহর কাছে রহমতের দোয়া করা হয়। ইসলামে রাসুল (সা.)–এর পরিবারের সদস্যদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। একজন মুসলিমের জন্য আহলে বাইত সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা এবং তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন অবশ্য কর্তব্য।

দোয়া-দরুদ ও হাদিসে নবীর পরিবারকে আহলুল বাইত বা আ-লে বাইত বলে অভিহিত করা হয়েছে। আহল শব্দটিরই একটি প্রতিশব্দ হলো আ-ল। আরবিতে এই শব্দের মূল অর্থ হলো পরিবার।

রাসুল (সা.)–এর আহলে বাইত বা পরিবারবর্গের জন্য সম্মানের কারণে সাদকা গ্রহণ করা হারাম। তবে তাঁদের জন্য মহান আল্লাহ যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক–পঞ্চমাংশ নির্ধারণ করেছেন।

কারা আহলে বাইত

বেশির ভাগ ইমামের মতে, রাসুল (সা.)–এর পরিবারবর্গের মধ্যে যাঁদের জন্য সদকা গ্রহণ করা হারাম, তাঁরাই আহলে বাইত। কারও মতে, তাঁরা হলেন বনু হাশিম। আবার কেউ বলেন, তাঁরা শুধু বনু মুত্তালিব। মূলত বনু হাশিম আর বনু মুত্তালিব একই। কারণ, হাশিমের চারজন ছেলের মধ্যে শুধু মুত্তালিবেরই বংশধারা বিস্তৃত হয়েছে। বাকি তিনজনের কোনো উত্তরাধিকার ছিল না।

আহলে বাইতের মধ্যে রাসুল (সা.)–এর স্ত্রীরাও অন্তর্ভুক্ত। সুরা আহযাবের ২২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাঁদের আহলে বাইত শব্দ উল্লেখ করেছেন। যদিও শিয়া মতে, নবীজির স্ত্রীরা আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত নন। এটি শিয়া ও সুন্নিদের সঙ্গে বিশ্বাসের মৌলিক পার্থক্যগুলোর একটি।

এ ছাড়া পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হলেন কন্যা ফাতেমা, তাঁর স্বামী আলী এবং তাঁদের দুই পুত্র হাসান ও হোসাইন (রা.)। রাসুল (সা.)–এর সন্তানদের মধ্যে তিনজন ছেলে ছোট বয়সে মারা যান। মেয়েদের মধ্যে শুধু ফাতেমা (রা.)–এর ছাড়া বাকি তিন মেয়ের কোনো সন্তান ছিল না।

আরও পড়ুন

আয়েশা (রা.) বলেন, একদিন সকালে রাসুল (সা.) বের হলেন। তাঁর পরনে ছিল একটি কালো পশমি চাদর। তখন হাসান ইবনে আলী এলেন এবং রাসুল তাঁকে চাদরের ভেতর ঢুকিয়ে নিলেন। এরপর হোসাইন ইবনে আলী এলেন। তাঁকেও রাসুল চাদরের ভেতর ঢুকিয়ে নিলেন। এরপর ফাতেমা এলেন। তাঁকেও তিনি চাদরের ভেতর নিলেন। এরপর এলেন আলী। তাঁকেও চাদর দিয়ে জড়িয়ে নিলেন এবং বললেন, ‘হে আহলে বাইত, মহান আল্লাহ তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে চান এবং তোমাদের ভালোভাবে পবিত্র করতে চান।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৪২৪)

এর বাইরে রাসুল (সা.)–এর চাচা আব্বাস (রা.)–এর পরিবার, চাচাতো ভাই আকিল ও জাফর (রা.)–এর পরিবার এবং রাসুলের চাচা হারিসের সন্তানেরাও আলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত। হারিসের সন্তানেরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং কয়েকজন রাসুল (সা.)–এর ইন্তেকালের পরও বেঁচেছিলেন।

আহলে বাইতের সাদকা গ্রহণ

যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বলেছেন, মক্কা ও মদিনার মাঝখানে ‘খুম্ম’ নামের একটি জলাশয়ের কাছে রাসুল (সা.) আমাদের সামনে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, ‘আমি আমার আহলে বাইতের বিষয়ে তোমাদের আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।’ এ কথা তিনি তিনবার উল্লেখ করেন।

এ হাদিসের বর্ণনাকারী সাহাবিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, রাসুল (সা.)–এর স্ত্রীরা কি আহলে বাইত? তিনি বলেছিলেন, তাঁর স্ত্রীগণ আহলে বাইত। এরপর তাঁর পরিবারের যাঁদের জন্য সাদকা হারাম, তাঁরাও আহলে বাইত। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৮,৪৬৪)

রাসুল (সা.)–এর আহলে বাইত বা পরিবারবর্গের জন্য সম্মানের কারণে সাদকা গ্রহণ করা হারাম। তবে তাঁদের জন্য মহান আল্লাহ যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক–পঞ্চমাংশ নির্ধারণ করেছেন এবং রাসুলও (সা.) তাঁদের সেসব সম্পদের কিছু অংশ প্রদান করেছিলেন।

আরও পড়ুন
হে আল্লাহ, আমি যার আপনজন, আলীও তার আপনজন। হে আল্লাহ, যে ব্যক্তি আলীর বন্ধু হয়, তুমি তার বন্ধু হও। আর যে ব্যক্তি আলীর শত্রু হয়, তুমি তার শত্রু হও।
মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৯৬১

আহলে বাইতের প্রতি কর্তব্য

বহু হাদিসে রাসুল (সা.) আহলে বাইতের বিভিন্ন সদস্যের মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন। হাদিসের গ্রন্থগুলোতে এসব হাদিস ‘মানাকিব’ তথা মর্যাদার হাদিস শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘গাদিরে খুম’ নামে পরিচিত ঘটনার প্রেক্ষাপটে আরেকটি হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, আমি যার আপনজন, আলীও তার আপনজন। হে আল্লাহ, যে ব্যক্তি আলীর বন্ধু হয়, তুমি তার বন্ধু হও। আর যে ব্যক্তি আলীর শত্রু হয়, তুমি তার শত্রু হও।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৯৬১)

আহলে বাইত–বিষয়ক অধ্যায়কে সামনে রাখলে বলা যায়, আহলে বাইতের প্রতি আমাদের প্রথম কর্তব্য হলো তাঁদের প্রতি সঠিক মনোভাব রাখা, তাঁদের সম্মান করা ও তাঁদের আদর্শ অনুসরণ করা। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) ‘আল আকিদা আল ওয়াসিতিয়া’ গ্রন্থে একই মত উল্লেখ করে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন, ‘রাসুল (সা.) আব্বাস (রা.)–কে বলেছেন, তারা ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তোমাদের ভালোবাসবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৭,৫১৫)

বনু হাশিমের প্রতি কুরাইশের বিরূপ মনোভাবের কারণে রাসুল (সা.) এ কথা বলেছিলেন। তবে তাঁর আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। বনু উমাইয়ার হাতে হোসাইন (রা.) শহীদ হন। আলী (রা.) ও হাসান (রা.)–কেও হত্যার শিকার হতে হয়। হোসাইন (রা.)–এর সঙ্গে নবী পরিবারের নারী ও শিশুদের শহীদ করা হয়েছিল।

এ ঘটনা আহলে বাইতের প্রতি বিদ্বেষের প্রমাণ। এ ঘটনার পর মুসলমানদের শিয়া মতবাদের আবির্ভাব হয় এবং মুসলিম জাতির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দের সৃষ্টি হয়। কেউ আহলে বাইতের কয়েকজন সদস্যের প্রতি অতিভক্তি ও ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে অন্য সাহাবিদের সম্পর্কে কটূক্তি করেন। আবার কেউ অন্যদের প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে আহলে বাইতের মর্যাদা উপেক্ষা করেন।

আহলে বাইত সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা এবং এ–সম্পর্কিত ভুল ধারণা থেকে বেঁচে থাকা একজন মুমিনের ইমানি কর্তব্য।

লেখক: এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন