দেনমোহর নির্ধারণের সঠিক পদ্ধতি

ছবি: পেক্সেলস

দেনমোহর (মোহরানা) হলো বিবাহের একটি মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোরআন ও সুন্নাহ–উভয় মাধ্যমেই এর বাধ্যতামূলকতা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। এটি স্ত্রীকে সম্মান দেওয়ার প্রতীক, আর্থিক নিরাপত্তার একটি অধিকার এবং স্বামীর দায়িত্ববোধের বাস্তব প্রতিফলন। ইসলামে দেনমোহর কোনো চাপ নয়; বরং পরস্পরের সম্মান, সম্মতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি ব্যবস্থা।

এই নিবন্ধে আমরা দেব—দেনমোহরের গুরুত্ব, নির্ধারণের নীতি, বাস্তব পদ্ধতি এবং ইসলামি আইনগত ব্যাখ্যা।

দেনমোহর কী এবং কেন

দেনমোহর হলো স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর জন্য নির্ধারিত একটি আর্থিক অধিকার, যা বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রী অবিলম্বে পাওয়ার যোগ্য হন। কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা নারীদের তাদের মোহর স্বেচ্ছায় (সৎভাবে) প্রদান করো।” (সুরা নিসা, আয়াত: ৪)

নবীজি (স.) বলেছেন, “যে নারীকে বিবাহ করবে, তার মোহরানা প্রদান করা তার ওপর কর্তব্য।” (সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস: ১৮৮০)

এটি স্পষ্ট যে দেনমোহর কোনো উপহার নয়; বরং একটি অধিকার।

দেনমোহর নির্ধারণ কীভাবে করা উচিত

ইসলামে দেনমোহর নির্ধারণের কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই। নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য কিছু নীতি আছে,

ক. সামর্থ্য অনুযায়ী নির্ধারণ: স্বামীর আর্থিক অবস্থাই এখানে মূল বিবেচ্য। কোরআনে বলা হয়েছ, “সামর্থ্যবান তার সামর্থ্য অনুযায়ী দেবে, আর যাঁর সামর্থ্য কম তিনি তার অবস্থান অনুযায়ী দেবেন।” (সুরা তালাক, আয়াত: ৭)

ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) লিখেছেন, “মোহরানার মূলনীতি হলো, স্বামীর সামর্থ্য অনুযায়ী ন্যায়সঙ্গত নির্ধারণ।” (ইলাম আল-মুআক্কিয়িন, ৩/১৩৫, দারুস সালাম, রিয়াদ, ২০০২)

খ. অযৌক্তিক ও অযথা বেশি নয়:  অত্যধিক উচ্চ দেনমোহর নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নবীজি (স.) বলেছেন, “সর্বোত্তম মোহর সেটাই, যা সবচেয়ে সহজ।” (সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস: ১৮৮৭)

সামাজিক প্রতিযোগিতা বা মর্যাদা দেখানোর জন্য অতিরিক্ত দেনমোহর নির্ধারণ ইসলামের দৃষ্টিতে অনুচিত।

আরও পড়ুন

গ. স্ত্রীর সম্মতি অপরিহার্য: দেনমোহর উভয় পক্ষের সম্মতিতে নির্ধারিত হবে। স্ত্রীর অনিচ্ছা বা চাপ প্রয়োগ করা জায়েজ নয়।

ঘ. তাৎক্ষণিক ও মুলতুবি অংশ: দেনমোহর দুই ভাগে হতে পারে, ১. তাৎক্ষণিক (মুহর মু’আজ্জাল), ২. মুলতুবি বা পরবর্তী সময়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি (মুহর মুআখখার)। উভয়টাই শরীয়তে গ্রহণযোগ্য। এছাড়া বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সমাজে দেনমোহর নির্ধারণের প্রচলিত পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে।

উপমহাদেশে প্রথাগতভাবে তিন পদ্ধতিতে দেনমোহর নির্ধারণ করতে দেখা যায়—

ক. স্বামীর আয়ের ভিত্তিতে: মাসিক আয়, সম্পদের পরিমাণ ও আর্থিক স্থিতি বিবেচনা করে যৌক্তিক পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এটি ইসলামের সবচেয়ে নিকটবর্তী পদ্ধতি।

খ. স্ত্রী পক্ষের পারিবারিক মর্যাদার ভিত্তিতে: এটিও বৈধ, যদি পরিমাণ অযৌক্তিক না হয়।

গ. উভয় পরিবারের পারস্পরিক আলোচনায়: এটিও বাস্তবসম্মত ও প্রণিধানযোগ্য।

কোনো ক্ষেত্রেই আদালত বা কাজীর রেজিস্ট্রি বইতে অস্বাভাবিক কম অর্থ (যেমন ১০১ টাকা) লেখা শরীয়তের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

দেনমোহরের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সীমা

হানাফি মাজহাবে সর্বনিম্ন দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়েছিল দশ দিরহাম। তবে অধিকাংশ সমসাময়িক আলেম বলেন, “এটি নির্দিষ্ট নূন্যতম পরিমাণ নয়; বরং সময়ের সামাজিক মানদণ্ড অনুযায়ী।” (মুফতি তাকী উসমানী, ফিকহুল বুয়ূ, মাকতাবা মাআরিফুল কোরআন, করাচি, ২০১০)

সর্বোচ্চ সীমা নেই; তবে অতি উচ্চ মাহর নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

দেনমোহর কত হলে ভালো হয়

১. স্বামীর ছয় মাস থেকে এক বছরের আয়ের মধ্যকার পরিমাণ অধিকাংশ ফকিহের মতে যৌক্তিক।

২. স্ত্রীর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এমন পরিমাণ হওয়া উত্তম।

৩. অতি সামান্য অর্থ (যেমন ৫০০ টাকা) সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং ইসলামের উদ্দেশ্যের বিপরীত।

ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, “মোহরনার মূল লক্ষ্য নিরাপত্তা, সম্মান ও স্থিতি।” (আল-উম্ম, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৩৫, দারুল মাআরিফ, কায়রো, ১৯৯০)

আরও পড়ুন

দেনমোহর প্রদান না করলে কী হবে

১. স্ত্রীর অধিকার ক্ষুণ্ন হবে।

২. স্ত্রী প্রয়োজন হলে আদালতে দাবি করতে পারবেন। (ফিকহুল ইসলামি, খণ্ড ৫, পৃপৃ. ৩৩৭)

৩. মৃত্যু বা তালাকের সময় সম্পূর্ণ দেনমোহর আদায় করতে হবে।

নবীজি (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কারো অধিকার আদায়ের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বিলম্ব করে, সে জুলুম করল।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৪০০)

দেনমোহরের সামাজিক তাৎপর্য

১. স্ত্রীকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেয়।

২. স্বামীকে দায়িত্বশীল করে।

৩. বিবাহ প্রতিষ্ঠানকে সম্মানজনক রাখে।

৪. বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্ত্রীর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

৫. সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।

ড. ওয়াহবা যুহাইলি লিখেছেন, “মোহরনা হচ্ছে ইসলামে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অন্যতম শক্তিশালী ব্যবস্থা।” (ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতুহু, খণ্ড ৭, পৃ. ৪৬১, দারুল ফিকর, দামাস্কাস, ১৯৯৭)

দেনমোহর কোনো আনুষ্ঠানিকতা বা প্রদর্শন নয়। এটি স্ত্রীকে সম্মান জানানোর ও নিরাপত্তা প্রদানের ইসলামি নীতি। সামর্থ্য অনুযায়ী, সম্মতি নিয়ে, যৌক্তিকভাবে এবং দায়িত্ববোধের সঙ্গে নির্ধারণ করাই সর্বোত্তম পদ্ধতি। ইসলামের উদ্দেশ্য হলো, বিবাহকে সুখ, নিরাপত্তা ও মানবিকতার ভিত্তিতে স্থাপন করা। দেনমোহর সেই ভিত্তির একটি অপরিহার্য স্তম্ভ।

আরও পড়ুন