উট মরুভূমির কঠিন জীবনযাত্রার এক অপরিহার্য সঙ্গী। আরবিতে যাকে ‘ইবল’, ‘জামাল’ বা ‘বাঈর’ বলা হয়। এই কুঁজবিশিষ্ট স্তন্যপায়ী ও চতুষ্পদী প্রাণীটি প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি, যার শারীরিক গঠন মরুভূমির তীব্র তাপ ও খরায় টিকে থাকার জন্য আশ্চর্যজনকভাবে উপযোগী। ইংরেজিতে এটি ‘ক্যামেল’ নামে পরিচিত। কোরআনে উটের বর্ণনায় এর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে তুলে ধরা হয়েছে।
কোরআনে উটের উল্লেখ
কোরআনে উটের উল্লেখ বিভিন্ন পটভূমিতে এসেছে, যা আরব সমাজে এর অপরিসীম গুরুত্বের প্রতিফলন ঘটায়। আরবদের জীবনে উট ছিল পরিবহন, খাদ্য ও সম্পদের প্রধান উৎস।
সুরা আনআম: এখানে ‘ইবল’ শব্দে উটের উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে এটিকে নর ও মাদি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে, অন্যান্য পশুর মতোই। এটি উটের সাধারণ জৈবিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করে। (আয়াত: ১৪৪)
ইউসুফ (আ.)-এর সময় মিসরে দুর্ভিক্ষের সময় তাঁর ভাইয়েরা খাদ্যসহায়তার জন্য এসেছিল। প্রত্যেককে একটি উটের বোঝার পরিমাণ খাদ্য দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে।
সুরা গাশিয়া: আল্লাহর সৃষ্টির মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে উটের আশ্চর্যজনক গঠনশৈলী উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা কি উটের দিকে তাকায় না, কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?’ এখানে উটের সঙ্গে আসমান, পাহাড় ও জমিনের উল্লেখ এসেছে, যা আরবদের জীবনের চারটি মৌলিক উপাদানের প্রতীক। (আয়াত: ১৭)
সুরা ইউসুফ: ‘আল-বাঈর’ শব্দটি দুবার ব্যবহৃত হয়েছে। ইউসুফ (আ.)-এর সময় মিসরে দুর্ভিক্ষের সময় তাঁর ভাইয়েরা খাদ্যসহায়তার জন্য এসেছিল। প্রত্যেককে একটি উটের বোঝার পরিমাণ খাদ্য দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে। (আয়াত: ৬৫, ৭২)
সুরা আল-আরাফ: ‘আল-জামাল’ শব্দটি একটি উপমা হিসেবে এসেছে। এখানে বলা হয়েছে, কাফেররা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, ‘যতক্ষণ না উট সুইয়ের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে।’ এই উপমা অসম্ভবতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। (আয়াত: ৪০)
নাকা: সুরা আল-হুদ (আয়াত: ১১), সুরা আশ-শামসসহ (আয়াত: ১১-১৪) মোট সাতবার ‘নাকা’ শব্দটি হজরত সালেহ (আ.)-এর সম্প্রদায় (সামুদ জাতি)-এর জন্য প্রেরিত বিশেষ উটের প্রতীক হিসেবে উল্লেখিত। এই উট ছিল আল্লাহর নিদর্শন, যা সামুদ জাতির অবাধ্যতার কারণে ধ্বংস করা হয়। (তাফসির ইবনে কাসির, সংশ্লিষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা)
উট বাবলাগাছের কাঁটা খেয়েও টিকে থাকতে পারে এবং প্রতিদিন ২০-২৫ মাইল পথ অতিক্রম করতে সক্ষম, এমনকি কয়েক মণ বোঝা বহন করেও।
উটের জৈবিক বৈশিষ্ট্য
উটের শারীরিক গঠন মরুভূমির চরম পরিবেশে টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত উপযোগী। উট দুই প্রকার: ড্রোমেডারি (এক কুঁজ) এবং ব্যাকট্রিয়ান (দুই কুঁজ)। কুঁজে চর্বি সঞ্চিত থাকে, যা খাদ্যের অভাবে শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে। কুঁজে পানি সঞ্চয়ের ধারণা ভুল, তবে উটের পাকস্থলীর পাশে বিশেষ থলিতে পানি জমা রাখার ক্ষমতা রয়েছে, যা এদের ৮-১০ দিন পর্যন্ত পানি ছাড়া টিকে থাকতে সাহায্য করে।
উটের পায়ের তলায় নরম প্যাড থাকে, যা বালুতে ডুবে যাওয়া রোধ করে। এদের তিন কক্ষবিশিষ্ট পাকস্থলী রোমন্থনকারী প্রাণীদের মতো কাজ করে, তবে এরা ‘ছদ্ম রোমন্থক’ হিসেবে পরিচিত। উট বাবলাগাছের কাঁটা খেয়েও টিকে থাকতে পারে এবং প্রতিদিন ২০-২৫ মাইল পথ অতিক্রম করতে সক্ষম, এমনকি কয়েক মণ বোঝা বহন করেও। উটের দীর্ঘ গলা ও পা মরুভূমির পথচলায় সহায়ক এবং এদের ছোট মাথা শরীরের তুলনায় হালকা। (কোরআন, আল-জাল্লাদ, এ (২০১৫), অ্যান আউটলাইন অব দ্য গ্রামার অব দ্য সাফাইটিক ইনস্ক্রিপশনস, ব্রিল; ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ‘ক্যামেলস’)
‘তারা কি উটের দিকে তাকায় না, কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?’সুরা গাশিয়া, আয়াত: ১৭
ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
আরব সমাজে উট ছিল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি পরিবহন, খাদ্য, দুধ ও মাংসের উৎস ছিল। মরুভূমির দীর্ঘ সফরে উট ছিল একমাত্র নির্ভরযোগ্য বাহন, যাকে ‘মরুভূমির জাহাজ’ বলা হয়। সমরাঙ্গনেও উটের ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ ভারতের বিকানের রাজ্যের ‘উট পল্টন’ ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত ছিল। মোটরযান আবিষ্কারের আগে যুদ্ধে উটের ভূমিকা ঘোড়ার কাছাকাছি ছিল।
উটের উৎপত্তি সম্ভবত উত্তর আমেরিকায়, যেখান থেকে এরা বেরিং প্রণালি পার হয়ে এশিয়া ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ আমেরিকায় গিয়ে এদের বংশধর হিসেবে লামা ও ভিকুন্যার উদ্ভব হয়। উটের মাংস ও দুধ মরুভূমিবাসীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য এবং এদের চামড়া ও পশম বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। (কোহলার-রলফসন, আই (১৯৯১), ক্যামেল পাস্টোরালিজম ইন দ্য মিডল ইস্ট, জার্নাল অব অ্যারিড এনভায়রনমেন্টস; এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, ‘ক্যামেল’।
উটের উৎপত্তি সম্ভবত উত্তর আমেরিকায়, যেখান থেকে এরা বেরিং প্রণালি পার হয়ে এশিয়া ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ আমেরিকায় গিয়ে এদের বংশধর হিসেবে লামা ও ভিকুন্যার উদ্ভব হয়।
উটের স্বভাব
উট সাধারণত শান্ত ও সহনশীল। তবে খেপে গেলে এরা ভয়ংকর হতে পারে এবং ধারালো দাঁত দিয়ে হামলা করতে পারে। এদের সহনশীলতা মরুভূমির কঠিন জীবনে অতুলনীয়। উটের শারীরিক গঠন, বিশেষ করে এদের পায়ের তলার শক্ত প্যাড, বালুকাময় পথে চলাচলের জন্য আদর্শ। (কোরআন, আল-জাল্লাদ, এ (২০১৫), অ্যান আউটলাইন অব দ্য গ্রামার অব দ্য সাফাইটিক ইনস্ক্রিপশনস, ব্রিল; ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ‘ক্যামেলস’)
উট কেবল একটি প্রাণী নয়, এটি মরুভূমির জীবনযাত্রার প্রতীক। কোরআনে এর বর্ণনা, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করে যে উট মানুষের জীবনে কতটা গভীরভাবে জড়িত। এই প্রাণীটি মরুভূমির কঠিন পরিবেশে মানুষের বেঁচে থাকার পথ সুগম করেছে।