রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যে পূর্বপুরুষেররা ব্যবসায়ী ছিলেন

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের জন্য বকরি বা ছাগল চরিয়েছেন, ব্যবসা করেছেন এবং ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে উপার্জন করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা করেছেন এবং বিভিন্ন বাণিজ্য সফরেও গিয়েছেন। ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, আরবের যে বংশে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম, সেটি ছিল একটি অভিজাত বণিক বংশ। ঐতিহ্যগতভাবে কুরাইশরা বণিক বংশ হিসেবে পরিচিত ছিল।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বংশে ঊর্ধ্বতন পুরুষদের মধ্যে কে বা কারা সরাসরি ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সে ইতিহাস জানার আগে তাঁর বংশলতিকাটি ভালোভাবে অধ্যয়ন করা যাক।

আরও পড়ুন

হাদিস ও ইতিহাস অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র বংশধারা এ রকম—‘মুহাম্মদ (সা.)–এর তাঁর পিতা আবদুল্লাহ, আবদুল্লাহর পিতা আবদুল মুত্তালিব (শায়বাতুল হামদ), আবদুল মুত্তালিবের পিতা হাশিম (আমর), হাশিমের পিতা আবদে মানাফ (মুগিরা), আবদে মানাফের পিতা কুসাই (জাইদ), কুসাইয়ের পিতা কিলাব, কিলাবের পিতা মুররা, মুররার পিতা কাব, কাবের পিতা লুআই, লুআইয়ের পিতা গালিব, গালিবের পিতা ফিহর (কুরাইশ), ফিহরের পিতা মালিক, মালিকের পিতা নজর (কাইস), নজরের পিতা কিনানা, কিনানার পিতা খুজাইমা, খুজাইমার পিতা মুদরিকা (আমর), মুদরিকার পিতা ইলিয়াস, ইলিয়াসের পিতা মুজার, মুজারের পিতা নিজার, নিজারের পিতা মাআদ, মাআদের পিতা আদনান।’ (ফাতহুর বারি, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা: ৬৪৬; সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১-২)

আরও পড়ুন

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বংশের ঊর্ধ্বতন অনেক সদস্য জীবনধারণের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। তাঁদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র বা অনেকের প্রধান মাধ্যম ছিল ব্যবসা। তাঁর বংশের যে বা যাঁরা ব্যবসা–বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন, ইতিহাসের আলোকে তাঁদের বর্ণনা তুলে ধরা যাক।

১. মুজার ইবনে নিজার: মুজার তাঁর উপাধি। পুরো নাম মুজার ইবনে নিজার। নিজারের পুত্র মুজার। পিতার মিরাস বা উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টনের সময় একটি লাল রঙের জিনিস তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য ইতিহাসের পাতায় তিনি মুজার হামরা নামের প্রসিদ্ধ বা পরিচিত। (তারিখুত তাবারি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ২৬) আদনানের বংশে মুজার ছিলেন সবচেয়ে সম্পদশালী। জানা যায়, এ সম্পদের একটা অংশ তিনি পৈতৃক সূত্রে পেয়েছিলেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সে সম্পদ বিনিয়োগ করে আরও সম্পদ উপার্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। (সিরাতে ইবনে ইসহাক, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৫৯)

আরও পড়ুন

২. ফিহর ইবনে মালিক: কুরাইশ বংশের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ বলা হয় ফিহর ইবনে মালিককে। তাঁর উপনাম ছিল গালিব। পেশায় ছিলেন সরদার। তবে বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যেও তাঁর উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল। (আনসাবুল আশরাফ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৪৬)

৩. কুসাই ইবনে কিলাব: তাঁর প্রকৃত নাম জাইদ। কুসাই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে স্বজাতির মধ্যে শাসনকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাইতুল্লাহর দেখাশোনা এবং হাজিদের খাদ্য-পানীয় সরবরাহ করাসহ দারুণ নাদওয়া পরিচালনার দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার পাশাপাশি তিনিই প্রথম বার্ষিক খাজনার রীতি প্রবর্তন করেছিলেন, যা দিয়ে তিনি দরিদ্র ও পাথেয়বঞ্চিত হাজিদের খাদ্যের ব্যবস্থা করতেন। কুসাই প্রত্যেক কুরাইশের ওপর এ খাজনা আবশ্যক করে বলেছিলেন, ‘হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী ও খাদেম। হারাম শরিফ এলাকায় বসবাসকারী। আর হাজি সাহেবেরা আল্লাহর মেহমান এবং তাঁর ঘর জিয়ারতকারী। অন্য মেহমানের চেয়ে তাঁরা সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার বেশি হকদার। হজের দিনগুলোতে তাঁদের খানাপিনার ব্যবস্থা করো।’ (তারিখুত তাবারি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ১৯)

আরও পড়ুন

কুরাইশরা কুসাইয়ের এ আবেদন স্বাগত জানিয়ে গ্রহণ করে নেন এবং প্রতিবছর রীতিমতো এ উদ্দেশ্যে খাজনা আদায় করতে থাকেন। এ খাজনা থেকে কুসাই হাজিদের মেহমানদারি করতেন এবং যত্নের সঙ্গে তাঁদের জন্য খাদ্য-পানীয় সরবরাহ করতেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৩০)

৪. হাশিম ইবনে আবদে মানাফ: আমরুল উলা বলে ডাকা হতো তাঁকে। পুরো নাম হাশিম ইবনে আবদে মানাফ। প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন। মক্কায় এক দুর্ভিক্ষের সময় শাম থেকে বিপুল পরিমাণ আটা ও রুটি এনে মক্কাবাসীকে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া শীত ও গ্রীষ্মকালে আরব বণিকদের বাণিজ্য সফরের রীতির উদ্ভাবকও হাশিম। তাঁর নেতৃত্বে শীতকালে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা ইয়েমেন ও হাবশায় এবং গ্রীষ্মকালে শাম ও গাজায় সফর করত। (মুহাম্মদ: হিজ লাইফ বেজড অন দ্য আর্লিয়েস্ট সোর্সেস, মার্টিন লিংস, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা: ০৬)

৫. আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম: পিতার ব্যবসায়িক ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন আবদুল মুত্তালিব। একবার হুজায়ফা নামের এক বন্দীকে ছাড়ানোর জন্য আবদুল মুত্তালিব বলেছিলেন, ‘আমার ব্যবসা ও সম্পদ সম্পর্কে তোমাদের কোনো ধারণা নেই। আমি শপথ করছি, তোমাদের ২০ উকিয়া স্বর্ণ অথবা ১০টি উট অথবা তোমরা যা চাও, তা প্রদান করব। হুজায়ফাকে ছেড়ে দাও।’ (আনসাবুল আশরাফ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৭৩) সম্পদের পরিমাণ অঢেল না হলে এভাবে কেউ বলতে পারে না। আবদুল মুত্তালিব যে ব্যবসার মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করেছিলেন, এ ব্যাপারে গবেষকেরা একমত।

পুত্র আবদুল্লাহকে কোরবানি দেওয়ার পরিবর্তে লটারি করে ১০০ উট জবাই করে গোশত বিতরণ করেছিলেন আবদুল মুত্তালিব। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১৫১-১৫৫; তাবাকাতে ইবনে সাদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৮৮-৮৯) ব্যবসা করে সম্পদ উপার্জন না করলে, এভাবে ১০০ উট কোরবানি করা সম্ভব হতো কি না সন্দেহ।

আরও পড়ুন

৬. আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব: পিতার ব্যবসায়িক ধারাবাহিকতাকে বজায় রেখেছিলেন আবদুল্লাহ। তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পিতা। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি বংশগত ঐতিহ্য গ্রহণ করে ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর ঘটনা থেকে জানা যায়, তিনি মূলত কুরাইশের একটি বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে ব্যবসার কাজে শামে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে তিনি পিতার কথামতো খেজুর আনতে গিয়েছিলেন।’ (মুসলিম উম্মাহর ইসিহাস বিশ্বকোষ, মূল: মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাইল রাইহান, অনুবাদ: রাইহান খাইরুল্লাহ, মাকতাবাতুল আযহার, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১৭৪) সফররত অবস্থায় তিনি অসুস্থ হওয়ার পর মদিনায় অবস্থান করেন এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। (তাবাকাতে ইবনে সাদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৯৯; মুসতাদরাক, আল হাকেম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ৬০৫)

 মিরাজ রহমান: লেখক

আরও পড়ুন