ইজতেমা শুরুর কাহিনি

ইজতেমা উপলক্ষে তুরাগতীরে হাজারো মুসল্লির ঢল। টঙ্গী, ১২ জানুয়ারি
ছবি: আল-আমিন

শুক্রবার ফজরের নামাজের পর আমবয়ানের (সবার উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতা) মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে প্রথম পর্বের ইজতেমা। তিন দিন ধরে ইজতেমায় নানা ধরনের কর্মসূচি থাকে। প্রথম পর্বে অংশ নেবেন মাওলানা জুবায়ের এর অনুসারী, আর ২০ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে মাওলানা সাদ কান্ধলভী অনুসারীদের আয়োজনে দ্বিতীয় পর্ব। ইজতেমায় অংশ গ্রহণকারীরা ইসলামের নানা দিক সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারেন। তাবলিগ জামাতের তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মিলনকে বিশ্ব ইজতেমা নামে চিহ্নিত করা হয়।

তাবলিগ জামাত একটি প্রভাবশালী ইসলামি আন্দোলন। সমগ্র বিশ্বে যা সর্বাধিক বিস্তৃত। ব্রিটিশ ভারতের দিল্লিতে ১৯২০-এর দশকে মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভী (র.)-এর (১৮৮৫-১৯৪৪) নেতৃত্বে এই আন্দোলনের সূচনা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত তাবলিগ জামাতের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য একজন মুসলমান ব্যক্তিকে ‘সত্যিকার’ মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলা। এর অর্থ হলো মুসলমান জনগোষ্ঠী যাতে সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে তাদের ধর্মচর্চা যথাযথভাবে করতে পারে। ধর্মীয় চর্চার মাধ্যমে একটি ইসলামি জীবন গঠনের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা তাদের আরও একটি লক্ষ্য।

তাবলিগ জামাত আরও একটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, সেটি হলো স্রষ্টার সঙ্গে ব্যক্তির সরাসরি যোগাযোগ তৈরি ও সেই যোগাযোগের মাত্রা বৃদ্ধি করা। এখানে কোনো ধরনের মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন নেই বলে তাঁরা মনে করেন। তাই এখানে ব্যক্তি ও তার আচরণ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ব্যক্তির সঙ্গে স্রষ্টার সরাসরি যোগাযোগের জন্যই তাবলিগ জামাত ব্যক্তির ওপর বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এ কারণে তাবলিগ জামাতকে ব্যক্তিক পরিসরে কাজ করতে দেখা যায়। ব্যক্তিকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ব্যক্তির পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব বলে তারা মনে করে। এখানে অবশ্য জাগতিক বিষয়াবলি থেকে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়, যেখানে স্রষ্টার সঙ্গে তাদের একটি সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।

তাবলিগ জামাতের ভাষ্য হচ্ছে এই কাজগুলো নতুন নয়, বরং একসময় প্রতিটি মুসলমানেরই এই দায়িত্ব ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তারা অনেকেই এই দায়িত্ব থেকে সরে আসার কারণেই মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভী (র.) দিল্লির মেওয়াত নামের একটি এলাকায় এই দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। তাঁর কাজের মাধ্যমেই একপর্যায়ে তাবলিগ জামাত বর্তমান কাঠামোর রূপ পায়।

বিংশ শতকের বিশের দশকের কোনো এক সময় তাবলিগ জামাতের যাত্রা মাওলানা ইলিয়াস (র.)-এর প্রচেষ্টায় ভারতের দিল্লির মেওয়াত নামক একটি এলাকা থেকে শুরু হয়। আর ঠিক এর পরের দশক থেকেই তাঁরা বার্ষিক ইজতেমার আয়োজন করে আসছেন বলে বিভিন্ন লেখা থেকে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম ইজতেমা আয়োজিত হয় ১৯৫৪ সালে লালবাগ শাহি মসজিদে। মানুষের ক্রমাগত আগ্রহের কারণে ১৯৬৬ সাল থেকে ইজতেমা টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে আয়োজিত হয়ে আসছে। তখন থেকেই বিশ্ব ইজতেমা আয়োজন করার ক্ষেত্রে তাবলিগ জামাত নানাভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেতে শুরু করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তাবলিগ জামাতের ইজতেমা আয়োজন করার জন্য প্রায় ১৬০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়।

মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভী (র.) ছিলেন একজন ইসলামি চিন্তাবিদ। তিনি ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন এই উপমহাদেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দ নামের একটি ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। সাধারণ মানুষের কাছে যা দেওবন্দ নামেই সমধিক পরিচিত। এই প্রতিষ্ঠান খুবই প্রভাবশালী ও নামকরা। বেশির ভাগ কওমি মাদ্রাসাছাত্রই এখান থেকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করার স্বপ্ন লালন করে থাকে। এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া করার মাধ্যমে মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী (র.) ইসলাম সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করেন। তারপরই তিনি তাবলিগ জামাত নামের এই আন্দোলনের সূচনা করেন, যা বর্তমানে উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে, বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে প্রায় ১৬৫টি দেশে তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম চালু রয়েছে, যা অভাবনীয় একটি বিষয়।

তাবলিগ জামাত পরবর্তী সময়ে সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করে তার বার্ষিক বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে। বাংলাদেশের ঢাকার তুরাগ নদের তীরবর্তী এলাকাজুড়ে আয়োজিত সেই ইজতেমায় বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েক লাখ অংশগ্রহণকারী জমায়েত হয় বলে মনে করা হয়। ইজতেমার কর্মকাণ্ড ধর্মপ্রাণ মানুষের জীবনে নানাবিধ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। আবার এই বিপুল অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতি এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাকেও বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে।

তথ্যসূত্র: তাবলিগ জামাত বাংলাদেশও বিশ্ব পরিসরে, বুলবুল সিদ্দিকী, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৯