আবু উবাইদা (রা.)–এর উপদেশ
হজরত উমর (রা.) খলিফা নিযুক্ত হয়ে ইয়ারমুকের যুদ্ধে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)–কে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন। তিনিও অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে এ যুদ্ধে মুসলিমদের পক্ষে বিজয় ছিনিয়ে আনেন। ১৮ হিজরিতে সিরিয়া অঞ্চলে মহামারি আকারে প্লেগ দেখা দিলে তাতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। আবু উবাইদা (রা.)–এর মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের যে উপদেশ আমি দিচ্ছি। তোমরা যদি তা মেনে চলো, তাহলে সব সময় কল্যাণের পথে থাকবে।
—তোমরা নামাজ কায়েম করবে।
—রমজান মাসে রোজা রাখবে।
—জাকাত দেবে।
—হজ ও ওমরাহ আদায় করবে।
—একে অন্যকে উপদেশ দেবে।
—তোমাদের শাসক ও নেতাদের সত্য ও ন্যায়ের কথা বলবে, তাদের কাছে কিছু গোপন রাখবে না।
—দুনিয়ার সুখ–সম্পদে গা ভাসিয়ে দেবে না।
কোনো ব্যক্তি যদি হাজার বছরও জীবন লাভ করে, আজ আমার পরিণতি তোমরা দেখতে পাচ্ছ, তারও একই পরিণতি হবে।’
৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে আবু উবাইদা (রা.)–এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী জেরুজালেম অবরোধ করে। খ্রিষ্টান ধর্মগুরু সাফ্রোনিয়াস জিজিয়া করের বিনিময়ে জান, মাল, গির্জা ও বাসস্থানের নিরাপত্তা দেওয়ার শর্তে মুসলিমদের সঙ্গে সন্ধি চুক্তি করেন। খ্রিষ্টানদের দাবি অনুযায়ী, সে সময় আবু উবাইদা (রা.)–এর আহ্বানে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রধান খলিফা উমর (রা.) জেরুজালেম এসে চুক্তিপত্রে মুসলিমদের পক্ষে স্বাক্ষর করেন।
৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে রোমের সম্রাটের প্ররোচনায় ৩০ হাজার জাজিরাবাসী মুসলিম আধিপত্য নির্মূলে অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মুসলিম সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিধানে আবু উবাইদা (রা.) তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে জাজিরা দখল করে নেন। এভাবে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করে আবু উবাইদা (রা.) মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
হজরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা.)–এর ইমামতিতে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)–এর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আবু উবাইদা (রা.)–কে কবর দেওয়ার পর মুয়াজ (রা.) এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, আবু উবাইদা (রা.), আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন। অসত্য কোনো কিছু বলব না। কারণ, আমি আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করি। আমার জানামতে, আপনি ছিলেন আল্লাহকে অত্যধিক স্মরণকারী ও বিনম্রভাবে জমিনের ওপর বিচরণকারীদের একজন। আর আপনি ছিলেন সেসব ব্যক্তিদের অন্যতম, যাঁরা তাঁদের রবের উদ্দেশে সিজদারত ও দাঁড়ানো অবস্থায় রাত অতিবাহিত করেন এবং যাঁরা খরচের সময় অপচয়ও করে না, আবার কার্পণ্যও করে না; বরং মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করে থাকে। আমার জানামতে, আপনি ছিলেন বিনয়ী ও এতিম-মিসকিনদের প্রতি সদয়। আপনি ছিলেন অত্যাচারী-অহংকারী ব্যক্তিদের শত্রুদের একজন।’
আবু উবাইদা (রা.) অনাড়ম্বর জীবনের অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। হজরত উমর (রা.)–এর খিলাফতকালে আবু উবাইদা (রা.) ছিলেন সিরিয়ার গভর্নর। হজরত উমর (রা.) তাঁর সিরিয়া সফরকালে দেখলেন, আবু উবাইদা (রা.)–এর পোশাক, বাসস্থানসহ সবকিছুতে খুব সাধারণ জীবনযাপনের চিহ্ন। একবার হজরত উমর (রা.) উপহার হিসেবে চার শ দিনার ও চার হাজার দিরহাম আবু উবাইদার কাছে পাঠালেন। তিনি সব অর্থ সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। নিজের জন্য এক পয়সাও রাখলেন না। হজরত উমর (রা.) এ কথা শুনে বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! ইসলামে এমন লোকও আছে!’
আবু উবাইদা (রা.) এতই বিনীত ছিলেন যে সিপাহসালার হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ সৈনিকদের থেকে তাঁকে আলাদা করা যেত না। অপরিচিত কেউ তাঁকে সিপাহসালার বলে ভুল করত। একবার এক রোমান দূত এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাদের সেনাপতি কে?’ সৈনিকেরা যখন আঙুল উঁচিয়ে আবু উবাইদা (রা.)–কে দেখিয়ে দিল, তখন তারা সেনাপতির অতি সাধারণ পোশাক ও অবস্থান দেখে হতভম্ব হয়ে গেল।
উমর (রা.)–এর কাছে তিনি এতই গ্রহণযোগ্য ছিলেন যে মৃত্যুর সময় উমর (রা.) বলেছেন, ‘আবু উবাইদা (রা.) বেঁচে থাকলে আমি তাঁকে পরবর্তী খলিফা বানিয়ে নিতাম।’
হজরত আয়েশা (রা.)–কে একবার জিজ্ঞেস করা হলো, সাহাবিদের মধ্যে রাসুল (সা.)–এর কাছে অধিক প্রিয় কে ছিলেন? আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আবু বকর (রা.), তারপর উমর (রা.) ও আবু উবাইদা (রা.)।’ (নাসায়ি: ৮২০১)
আবু উবাইদা (রা.) একজন আমানতদার ছিলেন। তাঁর আমানতদারির দৃষ্টান্ত মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুসরণীয় আদর্শ। আবু উবাইদা (রা.) ছিলেন সেসব সাহাবির অন্তর্ভুক্ত, যাঁরা দুনিয়ার জীবনে জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন এবং এ সুসংবাদ জানা সত্ত্বেও তাঁরা আল্লাহ ও রাসুল (সা.)–এর একনিষ্ঠ আনুগত্যে মশগুল থাকতেন।