বনি কুরাইজা যুদ্ধের বিচার

মহানবী (সা.)–র নেতৃত্বে যেখানে ইহুদি গোত্র বনি কুরাইজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়েছিল, সেই স্থানকে ‘মৃত্যু উপত্যকা’ নাম দিয়ে সেটিকে কেন্দ্র করে আজকাল দুনিয়াব্যাপী প্রোপাগাণ্ডা চালানো হচ্ছে। অনেকে তাকে ‘ফার্স্ট হলোকাস্ট’ বলেও অভিযোগ করতে চান। যদিও অনিবার্যভাবে কুরাইজার ওই ইহুদিদের খোদ তাদের কিতাব ও শরিয়তের আলোকে এবং তাদের প্রচলিত আইনের ভিত্তিতে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বিষয়টি তুলে ধরা যাক।

 ইহুদি গোত্রগুলোর সঙ্গে চুক্তি

মদিনায় আসার পর নবীজি (সা.)মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে চুক্তিপত্র লিখিয়েছিলেন, তাতে ইহুদিদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়। ইহুদি গোত্রগুলোর সঙ্গেও একটি চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছিল, যেখানে তাদের ধর্ম ও সম্পদ-সম্পত্তির সুরক্ষার দায়িত্ব নেওয়া হয়। এই চুক্তিপত্রে বিশেষভাবে বলা হয়েছিল. ‘ইহুদিদের মধ্যে যারা আমাদের সঙ্গ দেবে, তাদের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সাম্যের আচরণ করা হবে। তাদের ওপর অবিচার করা হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে সাহায্য দেওয়া হবে না।...ইহুদিরা যুদ্ধে যতদিন শরিক থাকবে, মুসলিমদের মতো তাদের সব ব্যয় বহন করা হবে। ইহুদিদের বিভিন্ন গোত্র (যেমন বনি আওফ, বনি সায়িদা ইত্যাদি) মুসলিমদের সঙ্গে এক জাতির মতো বসবাস করবে। তাদের নিজস্ব ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে, মুসলিমদেরও থাকবে নিজ ধর্মের ক্ষেত্রে। তারা তাদের অধীন ক্রীতদাস ও নিজস্ব বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন থাকবে।’ (নবীয়ে রহমত, পৃ. ২৬৭)

আরও পড়ুন

এটাও প্রচলিত ছিল যে, যুদ্ধকালে পরস্পরকে সহযোগিতা করা তাদের ওপর আবশ্যক হবে। বৈধ বিষয়াবলি ও খোদায়ি আনুগত্যের সীমার মধ্যে থেকে হিতকামনা, ঐকান্তিকতা ও সমঝোতার মানসিকতা রাখতে হবে। ইয়াস্রিবের ওপর আগ্রাসন হলে সমান অংশীদার হয়ে তারা মোকাবেলা করবে। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৫০৩-৫০৪)

বনি কুরাইজার সন্ধি ভাঙা

ইহুদি নেতা বনি নাজিরের নেতা হুয়াই বিন আখতাব ইহুদিদের মুসলিমদের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ভাঙতে এবং কোরাইশের সঙ্গে ঐক্য ও বন্ধুত্ব স্থাপনের জন্য বনি কুরাইজাকে প্রস্তুত করে ফেলে। অথচ তাদের নেতা কাব বিন আসাদ কুরাজি বলেছিলেন, আমি মুহাম্মাদের মধ্যে সততা ও বিশ্বস্ততা ছাড়া কিছু দেখি নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাব বিন আসাদ নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে এবং তার ও মহানবী (সা.)-র মধ্যে যা কিছু সিদ্ধান্ত ছিল, তা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা ২৭০)

চুক্তিভঙ্গের সংবাদ পেয়ে নবীজি (সা.) আওস গোত্রের নেতা সাদ বিন মুয়ায (রা.)–কে ও খাযরাজ গোত্রের নেতা সাদ বিন উবাদা (রা.)-কে সংবাদ যাচাইয়ের জন্য পাঠান। আওস ছিল বনি কুরাইজার মিত্র। খোঁজ নিয়ে তাঁরা দেখেন, যা শুনেছেন, অবস্থা তার চেয়েও ভয়াবহ। তারা নবীজি (সা.) সম্পর্কে অশোভন শব্দ ব্যবহার করে তিক্ত ভাষায় কথা বলছিল। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২২০-২২৩)

আরও পড়ুন

তারা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতিও শুরু করে দিতে এবং মুসলিমদের পিঠে পেছন থেকে ছুরি গেঁথে দিতে চাইছিল। কোরআন এদিকে ইঙ্গিত করে বলছে, ‘যখন তারা তোমাদের ওপর আক্রমণোদ্যত হয়েছিল উচ্চভূমি ও নিম্নভূমি থেকে।’ (সুরা আহযাব, আয়াত: ১০)

বনি কুরাইজায় অভিযান

নবীজি (সা.) বনি কোরাইজায় পৌঁছে অবরোধ করেন, যা লাগাতার পঁচিশ দিন চলে। অবশেষে তারাবার্তা পাঠায়. আপনি আমাদের কাছে বনি আমর বিন আওফকে পাঠিয়ে দিন (তারা আওসের মিত্র ছিল), যেন আমরা তার সঙ্গে পরামর্শ করতে পারি। কিন্তু সে-আলোচনা বিফল হয়। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৩৬-২৩৮)

শেষে তারা নবীজি (স.)-এর সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। আওস গোত্র কিছুটা দ্বিমত করে। নবীজি দায়িত্ব দেন খাযরাজ গোত্রের সাদ বিন মুয়ায (রা.)-কে। ইহুদিরা তার বিচার অকুণ্ঠচিত্তে মেনে নেয়। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, তারাই সাদকে তাদের বিচারক নির্ধারণের প্রস্তাব করে। সাদ বিন মুয়ায (রা.) বলেন, আজ আসমানি নির্দেশের সামনে সাদ কারও তিরস্কারের পরওয়া করবে না। আমি এই সিদ্ধান্ত দিচ্ছি, তাদের পুরুষদের হত্যা করা হোক, তাদের সম্পদ বিলিয়ে দেওয়া হোক, শিশু ও নারীদের দাস বানানো হোক। নবীজি (সা.) বললেন, তুমি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করেছ। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৩৯-২৪০)

দণ্ড কার্যকর করা হয়। নিহতদের সংখ্যা ছিল ৮০০। তারা সবাই যুদ্ধবাজ সৈনিক। (কামিল, খণ্ড ২, ইবনে আসির, পৃষ্ঠা ১২৭)

আরও পড়ুন

ইসরায়েলি বিধান অনুযায়ী সাজা

বিচারের রায়টি দেওয়া হয়েছিল ইহুদি ধর্মের সামরিক বিধি অনুসারে। তাওরাতে আছে, ‘যুদ্ধ করার জন্যে যখন তুমি কোনো শহরের মুখে পৌঁছবে, প্রথমে সন্ধির বার্তা দেবে। যদি সে সাড়া দেয় এবং দরোজা তোমার জন্য খুলে দেয়, তবে সবাই তোমাকে বিনীত কর দেবে এবং তোমার সেবা করবে। আর যদি সন্ধি না করে, বরং যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তবে অবরোধ করবে। তারপর তোমার প্রভু করায়ত্ব করে দিলে সেখানকার প্রত্যেক পুরুষকে তরবারির আঘাতে হত্যা করো; কিন্তু নারী, শিশু-কিশোর ও গৃহপালিত পশু এবং যা কিছু সেই শহরে থাকবে সব গনিমত সম্পদ তোমার জন্যে নিয়ে নেবে।’ (বিবরণ পুস্তক, অধ্যায় ২০, বাণী ১-১৪, পবিত্র গ্রন্থ, বাইবেল সোসাইটি)

প্রাচীনকাল থেকে বনি ইসরাইলে এটাই প্রচলিত ছিল। তাওরাতে আছে, ‘তারা মাদয়ানবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল, যেমনটি প্রভু মুসাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন; এবং সকল পুরুষকে হত্যা করল।...মাদয়ানের সকল নারী ও তাদের শিশুদের বন্দি করল এবং তাদের পশুগুলো, ভেড়া-বকরি ও আসবাবপত্র সবকিছু নিয়ে নিল। আর তাদের সব শহর, যাতে তারা থাকত এবং তাদের সব দুর্গ জ্বালিয়ে দিল।” (সংখ্যা পুস্তক, অধ্যায় ৩১, বাণী ৭-১০, পবিত্র গ্রন্থ, বাইবেল সোসাইটি)

মুসার (আ.)–এর আমলে এই বিধান অনুযায়ী কাজ করা হতো এবং এ ব্যাপারে তিনি অনুমোদন ও সমর্থন লাভ করেছিলেন।

আরও পড়ুন

অমুসলিম পণ্ডিতদের বিচার

খ্যাতিমান প্রাচ্যবিদ আর ভি সি বোদলে এই ঘটনার ওপর আলোকপাত করে লিখেছেন, ‘মুহাম্মাদ (সা.) যদি শৈথিল্য ও উদাসীনতার প্রশ্রয় দিতেন এবং বনি কুরাইজাকে তাদের চুক্তিভঙ্গের কারণে কোনো শাস্তি দেওয়া ছাড়া ছেড়ে দিতেন, তবে আরব উপদ্বীপে ইসলামের টিকে থাকা দুষ্কর হতো। সন্দেহ নেই যে, ইহুদিদের হত্যার বিষয়টি বেশ কঠোর ছিল। কিন্তু এটা ধর্মের ইতিহাসে কোনো আজনবি ও নতুন ঘটনা ছিল না এবং মুসলিমদের প্রেক্ষাপটে এ কাজের পূর্ণ বৈধতা বিদ্যমান ছিল। এর ফলে অন্যান্য আরব গোত্র ও ইহুদি গোষ্ঠী কোনো চুক্তিভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা করার আগে বারবার ভাবতে বাধ্য হয়। কেননা, তারা এর করুণ পরিণতি দেখে নিয়েছিল, নিজ চোখে চাক্ষুস করেছিল, মুহাম্মাদ তাঁর সিদ্ধান্ত কার্যকর করার শক্তি রাখেন। (দ্য মেসেঞ্জার: দ্য লাইফ অব মুহাম্মাদ, লন্ডন ১৯৪৬, পৃষ্ঠা ২২০)

প্রাচ্যবিদ স্যার স্ট্যানলি লেন–পুল লিখছেন, ‘এটা মনে রাখা উচিত যে তাদের অপরাধ ছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা এবং তা-ও একটি অবরোধের মধ্যবর্তী সময়ে। যারা ইতিহাসে এটা পড়েছে যে ওয়েলিংটনের সেনাদল যে পথ ধরে যেত, তাকে চিনিয়ে দিত পলাতক সৈন্য ও লুটেরাদের লাশ, যা গাছে ঝোলানো থাকত। সেখানে তাদের একটি বিশ্বাসঘাতক গোত্রের লোকদের একটি সাধারণ সিদ্ধান্তর বিচারে হত্যা করা নিয়ে আশ্চর্য হওয়া অসঙ্গত।

ইসরাঈল অলফিনসন বনি কুরাইজা যুদ্ধ পর্যালোচনা করতে গিয়ে বাস্তবতার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। (আল-ইয়াহূদ ফি বিলাদিল আরব, পৃষ্ঠা ১৫৫)

আরও পড়ুন