কোরআনের একটি সংস্করণ গ্রহণে সাহাবিদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা

ছবি: এএফপি

আমরা কোরআনের এখন কপি লিখিত কপি দেখি, কোরআন প্রথমে এমন ছিল না। কোরআনের বিভিন্ন আয়াত নাজিল হওয়ার পর কোথাও একটি জায়গায় লিখে রাখা হয় নি, বরং নানা অংশ নানান জনের কাছে সংরক্ষিত ছিল। কোনো কোনো আয়াতের লিখিত অংশ খুঁজে পায় যায় নি, শুধু হাফেজদের বক্ষে ধারণ করা ছিল।

ফলে ইসলামের ইতিহাসে কোরআন সংগ্রহণ এমন এক অধ্যায়, যা শুধু ধর্মীয় গ্রন্থের সংরক্ষণের গল্প নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, দূরদর্শিতা এবং আল্লাহর কালামের প্রতি অটুট ভক্তির প্রতিচ্ছবি।

এটি এমন একটি যাত্রা, যা নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর যুগ থেকে শুরু করে খলিফা আবু বকর (রা.) ও উসমান (রা.)-এর সময়কালে পূর্ণতা পেয়েছে। এই গল্পে রয়েছে সাহাবীদের ত্যাগ, তাদের দায়িত্ববোধ এবং কোরআনের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টা।

নবীজির জীবদ্দশায় কোরআন ছিল সাহাবীদের হৃদয়ে ধারণ করা। তারা এটি মুখস্থ করতেন এবং প্রতিদিনের জীবনে পড়তেন।

নবীজির যুগে কোরআনের প্রাথমিক সংরক্ষণ

মহানবী (সা.)-এর ওপর যখন কোরআন অবতীর্ণ হতো, তিনি তা অত্যন্ত যত্নসহকারে লিখিয়ে রাখতেন। ওহি লেখকদের মধ্যে জায়েদ বিন সাবিত (রা.) ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন তরুণ, বিশ্বস্ত এবং ওহি লেখার কাজে অভিজ্ঞ। (ইসমাইল বিন কাসির, ফাজাইলুল কোরআন, কায়রো, মাকতাবাতু ইবনে তাইমিয়া, ১৪১৬ হি./১৯৯৫ খ্রি., পৃষ্ঠা: ৯৩)

নবীজির জীবদ্দশায় সম্পূর্ণ কোরআন লিখিত হলেও তা একটি একক গ্রন্থাকারে সংকলিত ছিল না। খেজুরের পাতা, পাথরের টুকরো, চামড়ার টুকরো এবং সাহাবীদের স্মৃতিতে সংরক্ষিত ছিল।

আরও পড়ুন

কেন তখন একত্র করা হলো না? কারণ ওহির অবতরণ তখনো চলমান ছিল। কোরআনের সুরাগুলোর ক্রমও অবতরণের ক্রম অনুসারে নির্ধারিত ছিল না। সুরা বাকারা পরবর্তী সময়ে অবতীর্ণ হলেও কোরআনের ক্রমে এটি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। (ড. আহমাদ মুহাম্মাদ আল-কাজউল আল-হাশিমি, আল-খালিফাতুল মাজলুম উসমান বিন আফফান (রা.), বৈরুত, দারুল খাইর, ১৪৪৩ হি./২০২২ খ্রি., পৃষ্ঠা: ৬৭)

এই ক্রমধারা ছিল আল্লাহর ইচ্ছানুসারে নির্ধারিত, যাতে কোরআনের অখণ্ডতা ও পবিত্রতা রক্ষা পায়।

নবীজির জীবদ্দশায় কোরআন ছিল সাহাবীদের হৃদয়ে ধারণ করা। তারা এটি মুখস্থ করতেন এবং প্রতিদিনের জীবনে পড়তেন। এই মৌখিক সংরক্ষণ ছিল ইসলামের প্রাথমিক যুগের একটি শক্তিশালী ঐতিহ্য। তবে নবীজির ইন্তেকালের পর কোরআনের লিখিত সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আবু বকরের যুগ: প্রথম সংগ্রহণের সূচনা

খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর শাসনামলে ইসলামি রাষ্ট্র ‘রিদ্দা’ যুদ্ধের মুখোমুখি হয়। মুসাইলিমা কাজ্জাব নামের এক ভণ্ড নবীর বিরুদ্ধে পরিচালিত ইয়ামামা যুদ্ধে বহু কোরআনের হাফিজ শহীদ হন। (ইবনে হাজার  আল-আসকালানি, ফাতহুল বারি বিশারহি সাহিহিল বুখারি, কায়রো, দার মিসর লিলতিবা'আ, ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি., খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ২৩৬)

এই ঘটনা ওমর (রা.)-কে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে। তিনি আবু বকরের কাছে গিয়ে বলেন, “ইয়ামামায় বহু কোরআনের হাফেজের মৃত্যু হয়েছে। আমি আশঙ্কা করি, অন্যান্য যুদ্ধে আরও হাফিজ শহীদ হলে কোরআনের কিছু অংশ হারিয়ে যেতে পারে। তাই আপনি কোরআন সংগ্রহের নির্দেশ দিন।” (ইবনে হাজার  আল-আসকালানি, ফাতহুল বারি বিশারহি সাহিহিল বুখারি, কায়রো, দার মিসর লিলতিবা'আ, ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি., খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ৮৫৫)

আল্লাহর কসম, আমার কাছে পাহাড় সরানোর চেয়েও এই কাজ কঠিন মনে হয়েছে।
কোরআন সংকলেনর দায়িত্ব পাওয়ার পর জায়েদ বিন সাবিত (রা.)

আবু বকর (রা.) প্রথমে দ্বিধায় পড়েন। তিনি বলেন, “নবীজি যা করেননি, আমি তা কীভাবে করব?” কিন্তু ওমরের যুক্তি তাকে ভাবিয়ে তুলল। তিনি বুঝলেন, কোরআনের সংরক্ষণ ইসলামের ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য।

তাই তিনি জায়েদ বিন সাবিত (রা.)-কে এই দায়িত্ব দেন। জায়েদ ছিলেন তরুণ, বুদ্ধিমান এবং নবীজির ওহি লেখার কাজে অভিজ্ঞ। তিনি বলেন, “আল্লাহর কসম, আমার কাছে পাহাড় সরানোর চেয়েও এই কাজ কঠিন মনে হয়েছে।” (ইবনে হাজার  আল-আসকালানি, ফাতহুল বারি বিশারহি সাহিহিল বুখারি, কায়রো, দার মিসর লিলতিবা'আ, ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি., খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ৮৫৮)

জায়েদ (রা.) অক্লান্ত পরিশ্রমে কোরআন সংগ্রহ করেন। তিনি খেজুরের পাতা (উসুব), পাথরের টুকরো (লিখাফ) এবং সাহাবীদের স্মৃতি থেকে আয়াত সংগ্রহ করেন। (আল-মু'জামুল ওয়াসিত, বৈরুত, দার আমওয়াজ লিলতিবা'আ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওজি', ১৪০৭ হি./১৯৮৭ খ্রি., পৃষ্ঠা: ৬০০ – উসুবের সংজ্ঞা; পৃষ্ঠা: ৮২০ - লিখাফের সংজ্ঞা)

আরও পড়ুন

একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, সুরা তাওবার শেষ দুটি আয়াত (আয়াত: ১২৮-১২৯) শুধুমাত্র আবু খুজাইমা আল-আনসারি (রা.)-এর কাছে পাওয়া যায়, আর কারো কাছে না। (ইবনে হাজার  আল-আসকালানি, ফাতহুল বারি বিশারহি সাহিহিল বুখারি, কায়রো, দার মিসর লিলতিবা'আ, ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি., খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ৮৫৬)

এই সংগ্রহিত পত্রগুলো আবু বকরের জীবদ্দশায় তার কাছে রাখা হয়। তার ইন্তেকালের পর এটি ওমরের হেফাজতে এবং পরবর্তীতে হাফসা (রা.)-এর কাছে স্থানান্তরিত হয়। (ইবনে হাজার  আল-আসকালানি, ফাতহুল বারি বিশারহি সাহিহিল বুখারি, কায়রো, দার মিসর লিলতিবা'আ, ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি., খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ৮৬৩)

এই প্রথম সংগ্রহণ ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি ছিল কোরআনের অখণ্ডতা রক্ষার প্রথম ধাপ ছিল, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপন করে দেয়।

জায়েদ বিন সাবিত (রা.)-কে কেন বেছে নেওয়া হলো? ইবনে হাজার  (রহ.) বলেন, তাঁর তারুণ্য, বুদ্ধিমত্তা, বিশ্বস্ততা এবং ওহি লেখার অভিজ্ঞতা তাঁকে এই কাজের জন্য আদর্শ করে তুলেছিল।

উসমানের যুগে একটি সংস্করণে সকলের ঐক্য

খলিফা উসমান বিন আফফান (রা.)-এর সময়ে ইসলামি সাম্রাজ্য দ্রুত বিস্তার লাভ করে। সাহাবীরা বিভিন্ন প্রদেশে গিয়ে কোরআন ও ইসলামের শিক্ষা প্রচার করতেন। কিন্তু নতুন মুসলিমদের মধ্যে কোরআনের উচ্চারণে ভিন্নতা দেখা দেয়।

হুজাইফা বিন ইয়ামান (রা.) আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের যুদ্ধে এই সমস্যা লক্ষ্য করেন। তিনি খলিফাকে বলেন, “আমিরুল মুমিনিন, ইহুদি-খ্রিস্টানদের মতো এই উম্মাহর মধ্যে কোরআন নিয়ে বিভেদ হওয়ার আগে এটি সংগ্রহ করুন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৯৮৬)

খলিফা উসমান এই পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং হাফসা (রা.)-এর কাছ থেকে আবু বকরের সংগ্রহিত পত্র নিয়ে আসেন। তিনি জায়েদ বিন সাবিত, আবদুল্লাহ বিন জুবায়র, সাঈদ বিন আস এবং আবদুর রাহমান বিন হারিস (রা.)-কে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। তারা এই পত্রগুলো ‘মুসহাফে’ (কোরআনের কপি) অনুলিপি করেন।

উসমান (রা.) নির্দেশ দেন, কোনো অসঙ্গতি হলে কুরাইশি ভাষায় লিখতে হবে, কারণ কোরআন কুরাইশের ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৯৮৬)

কাজ শেষ হলে তিনি বিভিন্ন প্রদেশে মুসহাফ পাঠান এবং অন্যান্য সংস্করণ পোড়ানোর নির্দেশ দেন। এটি ছিল ঐক্যের এক অসাধারণ পদক্ষেপ।

জায়েদ বিন সাবিত (রা.)-কে কেন বেছে নেওয়া হলো? ইবনে হাজার  (রহ.) বলেন, তাঁর তারুণ্য, বুদ্ধিমত্তা, বিশ্বস্ততা এবং ওহি লেখার অভিজ্ঞতা তাঁকে এই কাজের জন্য আদর্শ করে তুলেছিল। (ইবনে হাজার  আল-আসকালানি, ফাতহুল বারি বিশারহি সাহিহিল বুখারি, কায়রো, দার মিসর লিলতিবা'আ, ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি., খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ৮৫৯)

ইতিহাসের শিক্ষা

কোরআনের সংগ্রহণের এই ইতিহাস আমাদের কয়েকটি গভীর শিক্ষা দেয়।

প্রথমত, আবু বকর (রা.)-এর সংগ্রহণ ছিল কোরআন হারানোর আশঙ্কা থেকে।

দ্বিতীয়ত, উসমান (রা.)-এর সংগ্রহণ ছিল উচ্চারণের ভিন্নতা দূর করে উম্মাহর ঐক্য স্থাপনের জন্য। প্রথম সংগ্রহণ ছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পত্রগুলো একত্র করা, আর দ্বিতীয় সংগ্রহণ ছিল তার অনুলিপি তৈরি করে বিস্তার করা। এই প্রক্রিয়া কোরআনের অখণ্ডতা নিশ্চিত করেছে।

এই কাহিনি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে কোরআন শুধু একটি গ্রন্থ নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক। সাহাবীদের ত্যাগ ও দূরদর্শিতা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। আজও কোরআন আমাদের হৃদয়ে ও হাতে অটুট রয়েছে, এবং এটি সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সকলের।

আরও পড়ুন