হজ শেষে হজের শিক্ষা লালন জরুরি

পবিত্র হজ শারীরিক, আর্থিক ও আত্মিক ইবাদত। হজে রয়েছে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা, যা জীবনব্যাপী প্রতিফলিত হয়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘সুবিদিত মাসসমূহে হজব্রত সম্পাদিত হয়। অতঃপর যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য অশ্লীলতা, কুৎসা, অন্যায় আচরণ, ঝগড়া ও কলহবিবাদ বিধেয় নয়।’ (সুরা-২ বাকারা; আয়াত: ১৯৭)

হজের শিক্ষা নিজের জীবনে লালন ও ধারণ করতে হবে। সর্বদা তর্কবিতর্ক ও ঝগড়াবিবাদ পরিহার করে চলতে হবে। কারও ব্যবহার পছন্দ না হলেও রাগ করা যাবে না বা কটুকথা বলা যাবে না, কারও মনে কষ্ট দেওয়া যাবে না। নিজের দ্বারা যদি কারও কোনো ক্ষতি হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। সব সময় অজুর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করতে হবে এবং মনে সব সময় আল্লাহর জিকির জারি রাখতে হবে।

নিজের স্বার্থ আগে উদ্ধার করার মানসিকতা পরিহার করতে হবে। নিজের আগে অন্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কোনো মানুষের হক নষ্ট করা যাবে না। নফসকে নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, নম্রতা, ভদ্রতা ও উদারতা শিক্ষায় দীক্ষিত ও উন্নীত করতে হবে।

পশু কোরবানি একটি প্রতীক মাত্র। মনের মধ্যে যে পশুবৃত্তি বিদ্যমান, তাকে পরাভূত ও পরাজিত করাই হলো পশু জবাই বা পশু কোরবানির মূল শিক্ষা

হজ মানবতার প্রশিক্ষণ। পৃথিবীর সব মানুষ একই পিতা–মাতার সন্তান। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই, সাদা–কালোয় কোনো প্রভেদ নেই। বর্ণবৈষম্য ও বংশকৌলীন্য, এগুলো মানুষের কৃত্রিম সৃষ্টি। পদ-পদবি ও অবস্থানগত পার্থক্যে মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া অদৃশ্য দেয়াল হজের মাধ্যমে দূরীভূত হয়।

জিলহজ মাসের ৭ তারিখে সব হাজি মিনার তাঁবুতে গণবিছানায় গিয়ে একাত্মতার ঘোষণা দেন। জিলহজের ৯ তারিখে হাজিরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে ঐক্যের অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেন; মিলিত হন আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে। এদিন সন্ধ্যায় (১০ জিলহজের রাতে) হাজিরা মুজদালিফায় গিয়ে সব কৃত্রিমতা অবসানের মাধ্যমে মানবতার পূর্ণতা ও আদি আসল প্রকৃত মানবরূপ প্রকাশ করেন।

সবার পদতলে মৃত্তিকা, মাথার ওপরে উন্মুক্ত আকাশ, সবার পরনে একই কাফনের কাপড়। পোশাকে বাহুল্য নেই, খোলা মাথা—পাগড়ি–টুপি ও বাহারি চুলের আড়ম্বর নেই; সঙ্গে সেবক–কর্মচারী নেই, গন্তব্য এক হলেও রাস্তা জানা নেই, নিজের শক্তি-সামর্থ্য ও জ্ঞানগরিমার প্রকাশ নেই, বুদ্ধিবিবেচনা ও কৌশল প্রয়োগের সুযোগ নেই; শুধুই আল্লাহর ওপর ভরসা। এটিই মানবতার পূর্ণতা, এটিই হজের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও আসল শিক্ষা।

হজে প্রতীকী শয়তানকে পাথর মারা হয়। কোরআন কারিমের সর্বশেষ সুরায় সর্বশেষ আয়াতে দুই প্রকার শয়তানের কথা উল্লেখ আছে। এর একটি হলো জিন শয়তান ও অপরটি মানুষ শয়তান। (সুরা-১১৪ নাস, আয়াত: ৬)। এ ছাড়া রয়েছে নফস শয়তান। (সুরা-১২ ইউসুফ, আয়াত: ৫৩)। ত্রিবিধ শয়তানের প্ররোচনা ও তাড়না থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং মনোজগতে শয়তানি শৃঙ্খল বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার ও সর্বপ্রকার শয়তানি ভাব ও প্রভাব মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে একমাত্র বিবেকের অনুসরণে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলার ইবাদত তথা আনুগত্য করাই হলো শয়তানকে পাথর মারার মূল হাকিকত।

কোরবানির মূল প্রতিপাদ্য হলো প্রিয়তমের জন্য অন্য সবকিছু বিসর্জন দেওয়া। পশু কোরবানি একটি প্রতীক মাত্র। মনের মধ্যে যে পশুবৃত্তি বিদ্যমান, তাকে পরাভূত ও পরাজিত করাই হলো পশু জবাই বা পশু কোরবানির মূল শিক্ষা। এর মাধ্যমে মনের সব কুভাব ও কুপ্রবৃত্তিকে চিরতরে বিদায় করা এবং চরিত্রের সব কুস্বভাব পরিত্যাগ করাই মুখ্য উদ্দেশ্য।

হজের সময় বর্ণ, শ্রেণি, দেশ, জাতি, মত, পথ ও পেশানির্বিশেষে সব দেশের সব মানুষ এক ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করেন। এ হলো ‘ভিন্নমতসহ ঐক্যে’র অনন্য দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ সহাবস্থান করেন বলে ভাষার দূরত্ব দূর হয়ে মনের নৈকট্য অর্জন হয় এবং প্রকৃত মানবিক অনুভূতি জাগ্রত হয়। মনের সংকীর্ণতা দূর হয়, দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয় ও চিন্তার বিকাশ সাধিত হয়।

একদেশদর্শী মনোভাব দূরীভূত হয়ে বহুদর্শিতা ও দূরদর্শিতা অর্জিত হয়, যা বিশ্বশান্তির জন্য অপরিহার্য।

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

  • [email protected]