হিলফুল ফুজুলের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসায়িক নিরাপত্তা

রাসুলুল্লাহ (সা.) শুধু মধ্যজীবন থেকে শান্তির বার্তাবাহী ও ইসলামের বাণী প্রচারক হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেননি, সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সব সময়ই তাঁর অবস্থান ছিল কঠোর। ছোটবেলা থেকেই মানবতার পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। মানুষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন অনন্য।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সামাজিক উদ্যোগ হলো হিলফুল ফুজুল সংগঠন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত থাকা।

আমরা অনেকেই জানি, শুধু সামাজিক কিছু সমস্যা নিরসনের উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.) হিলফুল ফুজুল নামে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু যে তথ্যটির তেমন প্রচার নেই, তা হলো হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠার নেপথ্য কারণগুলোর অন্যতম ছিল আরবজুড়ে ব্যবসায়িক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

আরও পড়ুন

সে সময়ে দূরদূরান্তে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বাণিজ্য কাফেলা সফর করত। কাফেলার সঙ্গে পণ্যসহ নগদ অর্থ থাকত। ব্যবসায়ী কাফেলা লুটপাট করার জন্য আরবের একশ্রেণির লুটেরা ওঁত পেতে থাকত। এ ছাড়া জুলুম-নির্যাতনের অবাধ চর্চায় নিমজ্জিত সেকালের অনেক ধনী বা বড় ব্যবসায়ী-সরদাররা ছোট ব্যবসায়ীদের নানাভাবে ঠকাত।

হিলফুল ফুজুল ছিল একটি শান্তিসংঘ। নবুয়তের ১৫ বছর আগে মাত্র ২৫ বছর বয়সে এ শান্তিসংঘ প্রতিষ্ঠাকেন্দ্রিক কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। হারবুল ফিজার বা ‘অন্যায় সমর’ নামে একটি যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণামের পরিপ্রেক্ষিতে এমন একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজন সামনে এসেছিল—এই ইতিহাস আমাদের অনেকেরই কমবেশি জানা আছে। কিন্তু এ শান্তিসংঘ প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে ব্যবসায়িক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল।

আরও পড়ুন

প্রথমেই হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠার নেপথ্য লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বা এর কর্মসূচি বা ধারাগুলো জেনে নেওয়া যাক।

১. দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা।

২. বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করা।

৩. অত্যাচারিতকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করা।

৪. দুর্বল, অসহায় ও এতিমদের সাহায্য করা।

৫. বিদেশি বণিকদের জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

৬. সর্বোপরি সব ধরনের অন্যায় ও অবিচার অবসানের চেষ্টা করা।

বিদেশি বণিকদের জান ও মালের নিরাপত্তা বিধান বাস্তবায়ন করাও এই শান্তিসংঘ প্রতিষ্ঠার অন্যতম একটি কারণ ও উদ্দেশ্য ছিল। হিলফুল ফুজুলের কর্মসূচিতে এই শর্ত যুক্ত করার পেছনে ঐতিহাসিক একটি কারণ ছিল।

আরও পড়ুন

জুবাইদ গোত্রের এক ব্যবসায়ী একবার পণ্য নিয়ে মক্কায় আসেন। আস বিন ওয়াইল সাহমি তাঁর সব পণ্য কিনে নেন। আস বিন ওয়াইল অনেক বড় সরদার ছিলেন। সে দম্ভে ওই ছোট ব্যবসায়ীর পাওনা অর্থ আর পরিশোধ করলেন না। অনেক আবেদন করার পরও টাকা দিলেন না। বঞ্চিত ব্যবসায়ী বঞ্চনার এ অভিযোগ নিয়ে আহলাফ গোত্রের আবদুদ্দার, মাখজুম, জুমাহ, সাহাম ও আদি বিন কাবের কাছে গিয়ে অর্থ উদ্ধার করে দিতে তাঁদের সাহায্য চাইলেন। তাঁরা ওই ব্যবসায়ীকে সাহায্য না করে উল্টো প্রাণনাশের হুমকি দিলেন। এমন অসহায় পরিস্থিতিতে জুবাইদ গোত্রের ব্যবসায়ী হতাশ হয়ে পড়লেন। পরদিন সূর্যোদয়ের সময় তিনি আবু কুবাইস পাহাড়ে চড়ে উচ্চকণ্ঠে একটি কবিতা পড়তে লাগলেন। সে সময় কুরাইশের লোকেরা কাবার আশেপাশে বসা ছিলেন। কবিতাটি ছিল এ রকম:

হে আলে ফিহর (কুরাইশ)! এ মজলুমকে সাহায্য করো!

যার ব্যবসায়িক পণ্য ছিনতাই করে নেওয়া হয়েছে।

সে এখানে ভিনদেশি!

নিজ বন্ধু–স্বজন থেকে অনেক দূরে।

সে ইহরাম বেঁধে আছে অথচ সে পেরেশান!

এখনো ওমরা পূর্ণ করতে পারেনি।

হে হাজরে আসওয়াদ ও হাতিমে আগমনকারী লোকেরা!

আমাকে সাহায্য করো!

মান-সম্মান শুধু ওই ব্যক্তির, যার কর্ম ভালো হয়।

প্রতারক ও মন্দলোকের চাদরের কোনো সম্মান নেই।

তাঁর আর্ত ফরিয়াদ শুনে জুবাইর বিন আবদুল মুত্তালিব তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘এই মজলুমকে কি এমন অসহায় ও নিরুপায় ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে?’

আরও পড়ুন

বিষয়টি নিয়ে বনু হাশিম, বনু মুত্তালিব, আসাদ ইবনে আবদুল উজজাহ, জোহরা ইবনে কিলাব, তাইম ইবনে মুররাহ প্রমুখ আবদুল্লাহ বিন জুদআনের বাড়িতে সমবেত হলেন। তাঁরা নিজেরা সংকল্প করলেন, জালেমের কাছ থেকে মজলুমের হক আদায় না করা পর্যন্ত তাঁরা মজলুমের সাহায্যের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। (আর রাহিকুল মাখুতুম, সফিউর রহমান মুবারকপুরি, পৃষ্ঠা: ৫৯)

তাঁরা বললেন, ‘আমরা এ চুক্তির ওপর ওই সময় পর্যন্ত অটল থাকব, যতক্ষণ পর্যন্ত সমুদ্রের পানির একটি ফোঁটা এবং সাবির ও হেরা পাহাড়ের অস্তিত্ব টিকে থাকবে। এ ছাড়া আমরা দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানেও একে অন্যের পাশে থাকব। (আর-রওজুল উনুফ, আস-সুহাইলি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১৪২-২৪৩; সিরাত বিশ্বকোষ, মাকতাবাতুল আযহার, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ২৭৯-২৮০)

এরপর তাঁরা আস ইবনে ওয়াইলের কাছে গিয়ে মজলুম জুবাইদি ব্যবসায়ীর হক আদায় করে দিতে তাঁকে বাধ্য করেন। (আর-রউজুল উনুফ, আস-সুহাইলি, খণ্ড: ০১, পৃষ্ঠা: ১৫৫)

এই চুক্তিটিই ‘হিলফুল ফুজুল’ তথা ‘অসহায় বান্ধব শপথ চুক্তি’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এতে শরিক ছিলেন এবং ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন যে ঘরে হয়েছিল, সেখানেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। (আল্লাহর পর শ্রেষ্ঠ যিনি, ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৯২)

আরও পড়ুন

সেদিনের মজলিশে উপস্থিত সবাই মজলুমের হক তাঁর কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং জালিমের জুলুম প্রতিরোধ করাসহ যেসব বিষয়ে শপথ নিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল, আর্থিক বিষয়ে মানুষকে সহমর্মিতা প্রদর্শন করা। (ফিকহুস সিরাহ, গাজবান, পৃষ্ঠা: ১০২; সুবুলুল হুদা, পৃষ্ঠা: ১৫৪)

বিভিন্ন বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠার অন্যতম নেপথ্য কারণ ছিল গোটা আরবে সুষ্ঠুভাবে ও নিরাপদে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পাদন নিশ্চিত করা। কোনো ব্যবসায়ী যাতে অন্য কোনো ব্যবসায়ীকে ক্ষমতার জোরে ঠকাতে না পারেন এবং কোথাও কোনোভাবে যেন কোনো বাণিজ্য কাফেলা ডাকাতের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার নিরাপত্তা বিধান করা।

 মিরাজ রহমান: লেখক

আরও পড়ুন