ইবাদতে একঘেয়েমি লাগলে কী করবেন

ইবাদতের সময় যদি আপনার মনে হয়, কাজটি একঘেয়ে হয়ে গেছে, তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। হতে পারে এটি আপনার আধ্যাত্মিক বিকাশের একটি সুযোগ। এটা শুনে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু সত্যিই তা–ই। আমরা অনেক সময় নামাজে দাঁড়িয়ে হাই তুলি, সদকা দিতে গিয়ে উৎসাহ হারাই বা রোজা রাখতে গেলে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি অনুভব করি না।

এ একঘেয়েমি আমাদের ইবাদতের পথে বাধা নয়; বরং এটি আমাদের আরও গভীরভাবে আল্লাহর কাছে যাওয়ার আমন্ত্রণ। আমরা আলোচনা করব কেন এ একঘেয়েমি আসে, এর পেছনের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য কী এবং কীভাবে আমরা এটিকে জয় করে আমাদের ইবাদতকে আরও অর্থবহ করতে পারি।

আমরা অনেক সময় নামাজে দাঁড়িয়ে হাই তুলি, সদকা দিতে গিয়ে উৎসাহ হারাই বা রোজা রাখতে গেলে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি অনুভব করি না।

একঘেয়েমির কারণ কী

ইবাদতে একঘেয়েমি এমন একটি অবস্থা, যখন আমাদের নিয়মিত ধর্মীয় কাজগুলো আর আগের মতো আনন্দ বা তৃপ্তি দেয় না। এটি একটি আধ্যাত্মিক মরুভূমির মতো, যেখানে আমরা দুটি প্রশান্তি পেতে পারি।

প্রথম প্রশান্তি ছিল, যখন আমরা ইবাদতের মাধুর্য প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম—নামাজে গভীর মনোযোগ, রোজায় প্রশান্তি বা জিকিরে হৃদয়ের শান্তি। দ্বিতীয় প্রশান্তি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য, যদি আমরা ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে এই শুষ্ক সময় অতিক্রম করতে পারি।

আরও পড়ুন

এই একঘেয়েমির একটি উপমা হতে পারে জিমে ব্যায়ামের কথা। যখন আমরা প্রথম ব্যায়াম শুরু করি, তখন দ্রুত ফল পাই—মাংসপেশি শক্ত হয়, শরীর ফিট হয়। কিন্তু একসময় আমরা একটি সমতল অবস্থায় পৌঁছে যাই, যেখানে আর কোনো উন্নতি হয় না। এ সময়ে হতাশা আসতে পারে, কিন্তু এটি কি ব্যায়াম ছেড়ে দেওয়ার সময়, নাকি ধৈর্য ধরে চালিয়ে যাওয়ার সময়?

ইবাদতের ক্ষেত্রেও তা–ই। এই একঘেয়েমি আমাদের আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ককে হয় নষ্ট করতে পারে, নয়তো আরও গভীর করতে পারে। শয়তান আমাদের নফসের সঙ্গে মিলে ফিসফিস করে বলে, ‘এতে আর মজা নেই, তাহলে কেন করছ?’

কিন্তু এই একঘেয়েমি আসলে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা হতে পারে। তিনি হয়তো ইবাদতের মাধুর্য সাময়িকভাবে সরিয়ে নিচ্ছেন, যাতে আমাদের হৃদয়ের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পায়—আমরা কি আধ্যাত্মিক উচ্ছ্বাসের জন্য ইবাদত করি, নাকি শুধু আল্লাহর জন্য?

ইমান হৃদয়ে এমনভাবে ক্ষয়ে যায়, যেমন কাপড় ঘন ঘন ব্যবহারে ক্ষয়ে যায়। তাই তোমরা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বেশি বেশি বলে তোমাদের ইমান নবায়ন করো।
মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৮৭৮৮

কখনো কখনো এই একঘেয়েমি আমাদের পাপের কারণেও হতে পারে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের তওবার দিকে ফিরে আসার একটি ইঙ্গিত। কিন্তু যাহোক না কেন, এ সময়ে ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে ইবাদত চালিয়ে যাওয়া আমাদের ইমানের প্রকৃত গভীরতা প্রকাশ করে। যখন আমরা আনন্দ না পেয়েও ইবাদত করি, তখন আমরা প্রমাণ করি যে আমাদের ইবাদত শুধুই আল্লাহর জন্য, কোনো বিনিময়ের আশায় নয়।

একঘেয়েমি কাটিয়ে ওঠার উপায়

ইবাদতে একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠতে আমরা কিছু ব্যবহারিক পদক্ষেপ নিতে পারি। এ পদক্ষেপগুলো আমাদের ইবাদতকে নতুন করে জীবন্ত করে তুলতে পারে। নিচে কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো—

১. একঘেয়েমি স্বীকার করুন

প্রথম ধাপ হলো এই একঘেয়েমিকে স্বীকার করা। এটি কোনো দুর্বলতা নয়; বরং এটি একটি স্বাভাবিক মানবীয় অভিজ্ঞতা। এ অনুভূতিকে দমিয়ে না রেখে স্বীকার করুন, কিন্তু এটিকে আপনার ইবাদতের পথে বাধা হতে দেবেন না। এটি একটি সুযোগ হিসেবে দেখুন, যা আপনাকে আরও গভীরভাবে আল্লাহর কাছে নিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন

২. ইমান নবায়ন করুন

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ইমান হৃদয়ে এমনভাবে ক্ষয়ে যায়, যেমন কাপড় ঘন ঘন ব্যবহারে ক্ষয়ে যায়। তাই তোমরা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বেশি বেশি বলে তোমাদের ইমান নবায়ন করো।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৮৭৮৮)

যখন ইবাদত যান্ত্রিক মনে হয়, তখন জিকিরের মাধ্যমে হৃদয়কে পুনরুজ্জীবিত করুন। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’—এই জিকিরগুলো হৃদয়ে নতুন আলো জ্বালাতে পারে।

৩. ইবাদতে বৈচিত্র্য আনুন

নামাজে একঘেয়েমি? নতুন একটি মসজিদে নামাজ পড়ে দেখুন। নামাজে ভিন্ন ভিন্ন সুরা তিলাওয়াত করুন। সিজদায় আপনার হৃদয়ের গভীরতম চাওয়া নিয়ে দোয়া করুন। এই ছোট ছোট পরিবর্তন আপনার ইবাদতকে নতুন রূপ দিতে পারে।

৪. নিজেকে চ্যালেঞ্জ করুন

যে সদকা আপনি দায়সারাভাবে দিয়ে থাকেন, তা দ্বিগুণ করুন। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে একটি সদকার প্রকল্পে অংশ নিন। রোজার ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ নিন, যেমন নবী দাউদ (আ.)-এর রোজা, যিনি এক দিন রোজা রাখতেন এবং পরের দিন রাখতেন না। এ ধরনের চ্যালেঞ্জ আমাদের নফসকে জাগিয়ে তুলতে পারে।

এই একঘেয়েমি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ককে নষ্ট করতে পারে, আবার গভীরও করতে পারে। শয়তান আমাদের ফিসফিস করে বলে, ‘এতে আর মজা নেই, তাহলে কেন করছ?’

৫. ইবাদতের পরিবেশ পরিবর্তন করুন

কখনো কখনো আমাদের হৃদয় নতুন পরিবেশে প্রাণ ফিরে পায়। বাড়ির নামাজের জায়গা বদলে ফেলুন। কোরআন পড়তে পার্কে যান। এমনকি একটি সংক্ষিপ্ত ভ্রমণও আপনার আধ্যাত্মিক অবস্থাকে রিফ্রেশ করতে পারে।

আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘এবং তোমার রবের ইবাদত করো, যতক্ষণ না তোমার কাছে নিশ্চিত মৃত্যু আসে।’ (সুরা হিজর, আয়াত: ৯৯)

ইবাদত একটি জীবনব্যাপী যাত্রা। ম্যারাথন দৌড়ের মতো, এ পথে ক্লান্তি বা বাধা আসা স্বাভাবিক। একজন ম্যারাথন দৌড়বিদ ২০ মাইল দৌড়ানোর পর যখন ‘দেয়ালে’ আঘাত পান, তখন তিনি থেমে যান না। তারা দেয়াল ভেদ করে এগিয়ে যান। ইবাদতের ক্ষেত্রেও তা–ই। একঘেয়েমি এলে হতাশ হবেন না। এটি একটি সুযোগ, যা আপনাকে আল্লাহর আরও কাছে নিয়ে যাবে।

মোটকথা, ইবাদতে একঘেয়েমি একটি স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা, যা প্রত্যেক আন্তরিক মুমিনের জীবনে আসে। এটি আমাদের ইমানের গভীরতা পরীক্ষা করে এবং আমাদের আরও নিষ্ঠার সঙ্গে আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয়। এ একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠতে আমাদের ধৈর্য, নিষ্ঠা ও কিছু ব্যবহারিক পদক্ষেপ প্রয়োজন।

সূত্র: প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডট কম

আরও পড়ুন