হিজরি কালপঞ্জি: ইসলামি পরিচয়ের ধারণা

মসজিদে নববি, মদিনা

আমরা অনেকেই শৈশবে ইসলামি মাসগুলোর নাম মুখস্থ করেছি বা আমাদের সন্তানদের সুর করে সেগুলো শিখিয়েছি। কিন্তু আজ কজন আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি বারোটি হিজরি মাসের নাম? বা চারটি পবিত্র মাস কোনগুলো বা এই মুহূর্তে কোন মাস চলছে? রমজান, ঈদ, আরাফা বা আশুরার মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিন ছাড়া হিজরি ক্যালেন্ডার এখন আমাদের জীবনে শুধু একটি সাংস্কৃতিক নিদর্শন ছাড়া কিছু নয়। অথচ এই ক্যালেন্ডার বা কালপঞ্জির সঙ্গে পুনঃ সংযোগ আমাদের ইমানকে গভীর করতে পারে, আমাদের জীবনকে আল্লাহর পথে নিয়ে যেতে পারে। হিজরি ক্যালেন্ডার শুধু সময় মাপার হাতিয়ার নয়, এটি আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে সমৃদ্ধ করে।

হিজরি কালপঞ্জি: ইবাদতের একটি রূপ

কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই সূর্যকে উজ্জ্বল ও চাঁদকে আলোকিত করেছেন এবং এর জন্য নির্দিষ্ট পর্যায় নির্ধারণ করেছেন, যাতে তোমরা বছরের সংখ্যা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এসব সৃষ্টি করেছেন ‘হক’র উদ্দেশ্যে। তিনি জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন স্পষ্ট করেন।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ৫)

ইমাম কুরতুবি (মৃ. ৬৭১ হিজরি) এই ‘হক’-এর ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহ চাঁদকে সৃষ্টি করেছেন জ্ঞান ও নির্ভুলতার সঙ্গে, যা তাঁর সৃষ্টির প্রমাণ ও তাঁর ইচ্ছার সাক্ষ্য। ইবন আতিয়া (মৃ. ৫৪১ হিজরি) বলেন, এটি আল্লাহর বিধান ও তা অনুসরণের পথ। অর্থাৎ হিজরি ক্যালেন্ডার শুধু সময় মাপার জন্য নয়, এটি ইবাদতের একটি অংশ।

আমরা রমজানের জন্য আগাম পরিকল্পনা করি, কিন্তু আরাফা বা আশুরার রোজার কথা প্রায়ই জুমার খুতবায় খতিব উল্লেখ না করলে ভুলে যাই। হিজরি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলে আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর জন্য প্রস্তুতি নিতে পারি, যেমন গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে ছুটির জন্য আমরা পরিকল্পনা করি। পবিত্র মাসগুলো জানা আমাদের বেশি নেক আমল করার নিয়ত করতে উৎসাহিত করে। ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ চারটি মাসকে পবিত্র করেছেন, যেখানে পাপের গুরুত্ব বেশি এবং নেক আমলের প্রতিদানও বহুগুণ।’ (তাফসিরে ইবন কাসির, সুরা তাওবা: ৩৬ সংশ্লিষ্ট আলোচনা)

হিজরি ক্যালেন্ডার শুধু সময় মাপার জন্য নয়, এটি ইবাদতের একটি অংশ।
আরও পড়ুন

সুন্নাহ পালনের পথে হিজরি কালপঞ্জি

নবীজি (সা.) আমাদের প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখতে উৎসাহিত করেছেন, যা সারা বছরের রোজার সমতুল্য। (সুনান নাসাই, হাদিস: ২,৪৩৪)

এই সুন্নাহ আমরা তখনই পালন করতে পারি, যদি হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসরণ করি। নতুন চাঁদ দেখারও একটি সুন্নাহ আছে। নবীজি (সা.) নতুন চাঁদ দেখে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ, এই চাঁদ আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ইমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে উদিত করো। হে চাঁদ, আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ। এটি হোক হিদায়াত ও কল্যাণের চাঁদ।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৪৫১)

চাঁদের চক্র অনুসরণ আমাদের কোরআনের আয়াতগুলোর প্রতি চিন্তাশীল হতে উৎসাহিত করে, যেখানে চাঁদের নিখুঁত কক্ষপথের কথা বলা হয়েছে।

সুন্নাহ পুনরুজ্জীবনের পুরস্কার

নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাহকে পুনরুজ্জীবিত করে, যা আমার পরে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, সে তাদের সমান পুরস্কার পাবে, যারা তা পালন করবে, তাদের পুরস্কার কমানো ছাড়াই।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০১৭)

হিজরি কালপঞ্জি অনুসরণ একটি ছোট পদক্ষেপ মনে হতে পারে, কিন্তু এটি নবীজি (সা.)-এর সুন্নাহকে জীবিত করার একটি শক্তিশালী উপায়। আমরা আমাদের ঘরে হিজরি ক্যালেন্ডার টাঙাতে পারি, ফোনের ডিসপ্লেতে হিজরি তারিখ সেট করতে পারি বা প্রতি মাসে নতুন চাঁদ দেখতে যেতে পারি। এই ছোট ছোট পদক্ষেপ আমাদের পরিবার ও সম্প্রদায়কে আল্লাহর সময়ের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।

আসুন, আমরা এই সুন্নাহকে পুনরুজ্জীবিত করি, আমাদের জীবনকে আল্লাহর নৈকট্যের পথে নিয়ে যাই। এটি কেবল একটি ক্যালেন্ডার নয়, এটি আমাদের ইমানের প্রতিফলন, আমাদের পরিচয়ের অংশ।

সূত্র: প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম

নবীজি (সা.) নতুন চাঁদ দেখে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ, এই চাঁদ আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ইমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে উদিত করো। হে চাঁদ, আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ। এটি হোক হিদায়াত ও কল্যাণের চাঁদ।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৪৫১)
আরও পড়ুন