সাফিয়া (রা.) ছিলেন হুয়াই ইবনে আখতাব ও বারাহ বিনত শামওয়ালের কন্যা, এক সম্ভ্রান্ত ইহুদি বংশের সন্তান। খায়বারের যুদ্ধে তিনি বিধবা ও যুদ্ধবন্দী হন। মহানবী (সা.)-এর বিবাহের প্রস্তাব গ্রহণ করে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নবীজির সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করেন। (ফরিদা মাসউদ দেবাস, দ্য ওয়াইভস অব দ্য প্রফেট মুহাম্মদ, ২০০৬, পৃ. ১৩০)
তাঁর জীবন ছিল জ্ঞান, দৃঢ়তা, আধ্যাত্মিকতা এবং সমাজসেবার এক অনুপম সমন্বয়।
কোরআন পড়ার আগে তাঁর এত তীব্র ছিল যে পড়তে গিয়ে তাঁর চোখ অশ্রুতে ভরে যেত এবং তিনি কাঁদতেন।
সাফিয়া (রা.) কোরআন পড়তে এবং এর অনেক অধ্যায় মুখস্থ করতে সময় ব্যয় করতেন। কোরআন পড়ার আগে তাঁর এত তীব্র ছিল যে পড়তে গিয়ে তাঁর চোখ অশ্রুতে ভরে যেত এবং তিনি কাঁদতেন। (মাহমুদ আহমদ গজনফার, গ্রেট উইমেন অব ইসলাম, ২০০০, পৃ. ১২০)
নিজের বিষয়ে তিনি সাক্ষ্য দিয়ে বলতেন, ‘তিনি পুরোপুরি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং একজন উত্তম মুসলিম হয়েছেন।’ (ফরিদা মাসউদ দেবাস, দ্য ওয়াইভস অব দ্য প্রফেট মুহাম্মদ, ২০০৬, পৃ. ১৩২)
তিনি কোরআনের আয়াত কেবল আবৃত্তি করতেন না, বরং এর শিক্ষাকে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতেন। এই জ্ঞানই তাঁকে ন্যায় দাবি, ইসলামের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার রক্ষা, সম্পত্তির অধিকার এবং পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। (সুহাইব ওয়েব, দ্য মাদার্স অব দ্য বিলিভার্স: হজরত সাফিয়া বিনতে হুয়াই, ২০০৬)
তারা কীভাবে আমার চেয়ে উত্তম হবে, যখন আমার পিতা নবী হারুন, আমার চাচা নবী মুসা এবং আমার স্বামী নবী মুহাম্মদ?
একবার খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) নবীজির স্ত্রীদের জন্য সাম্প্রতিক বিজয়ের লভ্যাংশ হিসেবে প্রত্যেককে ১২ হাজার দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) বরাদ্দ করেন। কিন্তু সাফিয়া ও জুওয়াইরিয়া (রা.)-কে মাত্র ৬ হাজার দিরহাম দেওয়া হয়। উমরের যুক্তি ছিল, অন্য স্ত্রীরা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছেন, তাই তাঁরা বেশি পাবেন। সাফিয়া ও জুওয়াইরিয়া এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন এবং অর্থ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তাঁরা যুক্তি দেন, তাঁরা নবীজির স্ত্রী সকলে হিসেবে সমান মর্যাদার অধিকারী, তাই সমান অংশ পাওয়ার হকদার। তাঁদের এই দৃঢ় অবস্থানের কারণে উমর (রা.) সিদ্ধান্ত বদলান এবং তাঁদের ন্যায্য অংশ দেন। (আল-হিন্দি, কানযুল উম্মাল, ৫/৫৯৪)
ইহুদি বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে সাফিয়া প্রায়ই অভিযোগের সম্মুখীন হতেন। একবার তাঁর দাসী খলিফা উমরের কাছে অভিযোগ করে যে সাফিয়া ইসলাম গ্রহণ করলেও শনিবারের ‘সাবাথ’ পালন করেন এবং ইহুদিদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। উমর (রা.) তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সাফিয়া উত্তর দেন, আল্লাহ শুক্রবারের পবিত্রতা ও বরকত ঘোষণা করার পর তিনি শনিবারের গুরুত্ব ত্যাগ করেছেন। তবে তিনি তাঁর ইহুদি আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন, কারণ এটি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ—পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা। (ইবনে হাজার আসকালানি, আল-ইসাবা ফি তামইয আস-সাহাবা, ৭/৭৪১)
সাফিয়া (রা.) নবীজির সঙ্গে উন্মুক্তভাবে আলোচনা করতেন এবং প্রয়োজনে তাঁর পরামর্শ নিতেন। তিনি ইহুদি পরিবারের মেয়ে হওয়ায় প্রায়ই তাঁকে কথা শুনতে হতো। তিনি নবীজির কাছে এই সমস্যা তুলে ধরেন। নবীজি তাঁর অশ্রু মুছে দিয়ে বলেন: ‘তুমি কেন বলো না, “তারা কীভাবে আমার চেয়ে উত্তম হবে, যখন আমার পিতা নবী হারুন, আমার চাচা নবী মুসা এবং আমার স্বামী নবী মুহাম্মদ”?’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৮৯২)
নবীজি (সা.) সব সময় তাঁর পাশে থেকেছেন, এমনকি তাঁর পক্ষ থেকে অনুরোধ ছাড়াই তাঁর প্রতি আনুগত্যের সাক্ষ্য দিয়েছেন। নবীজির মৃত্যুশয্যায় সাফিয়া বিলাপ করে বলেছিলেন: ‘হে আল্লাহর নবী, আমি চাই, আপনার কষ্ট আমার মধ্যে চলে আসুক।’ অন্যরা তাঁর কথার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করলেও নবীজি বলেন: ‘আল্লাহর কসম, আমি জানি সাফিয়া আনুগত্যশীল ও সত্যবাদী। সে যা বলেছে, সত্যিই তা মনে করেছে।’ (ইবনে সাদ, কিতাব আত-তাবাকাত আল-কাবির, ৮/১২৮)
তিনি তাঁর ইহুদি আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন, কারণ এটি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ—পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা।
সাফিয়া (রা.) তাঁর সময়ের নাগরিক সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। খলিফা উসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিদ্রোহের সময় তিনি উসমানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি কেবল মৌখিক সমর্থনই দেননি, বরং সক্রিয়ভাবে বিদ্রোহ দমনে চেষ্টা করেছেন।
তিনি উসমানের সমর্থনে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তাঁর খচ্চর প্রস্তুত করেছিলেন, যদিও বিরোধীরা তাঁর এই প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত করে। (সুহাইব ওয়েব, দ্য মাদার্স অব দ্য বিলিভার্স: হজরত সাফিয়া বিনতে হুয়াই, ২০০৬)
তিনি উসমানের অবরুদ্ধ পরিবারকে সাহায্য করার জন্য তাঁর বাড়ি থেকে উসমানের বাড়ি পর্যন্ত একটি সেতু তৈরি করেন, যাতে তাঁরা খাদ্য ও পানি পেতে পারেন। (ইবনে সাদ, কিতাব আত-তাবাকাত আল-কাবির, ৮/১২৮)
এ ছাড়া তিনি সমাজের দরিদ্রদের জন্য তাঁর নিজের মালিকানাধীন একটি বাড়ি দান করেন। (ফরিদা মাসউদ দেবাস, দ্য ওয়াইভস অব দ্য প্রফেট মুহাম্মদ, ২০০৬, ১৩৮)
সূত্র: ইসলাম রিলিজিয়ন ডটকম