ইসলামে ‘কলব’ ও ‘আকল’–এর সম্পর্ক

মানুষের শরীরে যে অঙ্গটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত, সেটি হলো কলব বা হৃদয়। আমরা সাধারণত হৃদয়কে ভালোবাসা, অনুভূতি বা আবেগের কেন্দ্র বলে জানি। কিন্তু পবিত্র কোরআনে হৃদয়কে শুধু অনুভূতির জায়গা হিসেবে দেখানো হয়নি; বরং এটিকে বোঝাপড়া, চিন্তা, দায়িত্ব, ইমান–কুফরের কেন্দ্র এবং মানুষের সচেতনতার মূল উৎস হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

সুরা হাজ্জে (আয়াত: ৪৬) আল্লাহ বলেন, চোখ অন্ধ হয় না; বরং অন্ধ হয় বুকের ভেতরের হৃদয়। অর্থাৎ বাহ্যিক দৃষ্টি থাকলেও যদি হৃদয় অন্ধ হয়, তবে সত্য উপলব্ধি করা যায় না। এখান থেকেই প্রশ্ন ওঠে, কলব ও আকলের মধ্যে সম্পর্ক কী?

অনেক জিন ও মানুষ আছে, যারা জাহান্নামে যাবে। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা তা দিয়ে বোঝে না; চোখ আছে, কিন্তু দেখে না; কান আছে, কিন্তু শোনে না। তারা পশুর মতো, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট।
কোরআন, সুরা আরাফ, আয়াত: ১৭৯

কলব ও আকলের সম্পর্ক

ইসলামের দৃষ্টিতে এ দুটি কি আলাদা, নাকি একই সত্তার দুটি রূপ?

পবিত্র কোরআনের ভাষায় হৃদয় মানুষের বোঝার কেন্দ্র। অনেকে মনে করেন, আকল বা মস্তিষ্কই চিন্তার জায়গা। কিন্তু পবিত্র কোরআন বলছে, হৃদয় দিয়েই মানুষ বোঝে, চিন্তা করে। সুরা আরাফে (আয়াত: ১৭৯) বলা হয়েছে, অনেক জিন ও মানুষ আছে, যারা জাহান্নামে যাবে। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা তা দিয়ে বোঝে না; চোখ আছে, কিন্তু দেখে না; কান আছে, কিন্তু শোনে না। তারা পশুর মতো, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট।

এ আয়াত থেকে স্পষ্ট যে হৃদয়ই বোঝাপড়ার প্রধান অঙ্গ। যদি হৃদয় কাজ না করে, তবে চোখ ও কান থাকলেও কোনো লাভ নেই।

একইভাবে সুরা হাজ্জে (আয়াত: ৪৬) বলা হয়, পৃথিবীতে ভ্রমণ করলে হৃদয় দিয়ে চিন্তা করা যায়, কান দিয়ে শোনা যায়। অর্থাৎ হৃদয়কে এখানে আকল বা বুদ্ধির কেন্দ্র হিসেবে দেখানো হয়েছে।

এ থেকে বোঝা যায়, ইসলামে হৃদয় বা হৃৎপিণ্ড শুধু রক্ত পাম্প করে না, এটি মানুষের চিন্তাভাবনার মূল জায়গা। আধুনিক বিজ্ঞানও এখন বলছে, হৃৎপিণ্ডের নিজস্ব স্নায়ুতন্ত্র আছে, যা মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখে। কিন্তু পবিত্র কোরআন এ সত্য ১৪০০ বছর আগেই বলে দিয়েছে।

আরও পড়ুন

দায়িত্বের কেন্দ্র হৃদয়

হৃদয় শুধু বোঝার জায়গা নয়, এটি দায়িত্বের কেন্দ্রও। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, সাক্ষ্য গোপন করো না, যে গোপন করে, তার হৃদয় পাপী হয়। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৩)

অর্থাৎ পাপ–পুণ্যের দায়িত্ব হৃদয় বহন করে। হৃদয়ই সিদ্ধান্ত নেয় কোন কাজ করবে, কোনটা করবে না। এটি আনুগত্য করে অথবা অবাধ্য হয়। তাই হৃদয়কে পরিচালনা করা মানুষের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।

ইমান ও কুফরের ঠিকানা হৃদয়

ইমান ও কুফরের কেন্দ্রও হৃদয়। এক আয়াতে বলা হয়েছে, যে আল্লাহর প্রতি ইমান আনে, আল্লাহ তার হৃদয়কে হেদায়াত দেন। (সুরা তাগাবুন, আয়াত: ১১)

আবার বলা হয়েছে, যে ইমানের পর কুফর করে এবং কুফরের জন্য বুক প্রশস্ত করে, তার ওপর আল্লাহর গজব। কিন্তু যে বাধ্য হয়ে কুফর করে, কিন্তু তার হৃদয় ইমানে অটল, সে ক্ষমার যোগ্য। (সুরা নাহল, আয়াত: ১০৬)

এ থেকে বোঝা যায়, ইমান হৃদয়ে থাকে, কুফরও হৃদয়ে প্রবেশ করে। আয়াতে আরও বলা হয়েছে, আল্লাহ কখনো কোনো ব্যক্তির বুকের ভেতর দুটি হৃদয় রাখেন না। (সুরা আনফাল, আয়াত: ২৪)

অর্থাৎ হৃদয় একটি এবং এটি একই সঙ্গে ইমান বা কুফরের ঠিকানা।

হৃদয় সচেতনতার কেন্দ্রও। ওহি নাজিল হয় নবীজির হৃদয়ে। জিবরাঈল (আ.) ওহি নিয়ে আসেন হৃদয়ের ওপর, যাতে তিনি সতর্ককারী হন।

হৃদয় অনুভূতি ও সম্পর্কের কেন্দ্র

হৃদয় মানুষের অনুভূতি ও সম্পর্কের কেন্দ্র। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, মুমিনদের হৃদয়ের মধ্যে আল্লাহ ভালোবাসা সৃষ্টি করেন। পৃথিবীর সব সম্পদ ব্যয় করলেও এ সম্পর্ক তৈরি করা যেত না, কিন্তু আল্লাহ তৈরি করেছেন। এটি হৃদয়ের গভীর অনুভূতির সম্পর্ক। (সুরা আনফাল, আয়াত: ৬৩)

আবার অন্য আয়াতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর উদ্দেশে বলা হয়েছে, যদি তুমি রুক্ষ ও কঠিন হৃদয়ের হতে, তবে মানুষ তোমার কাছ থেকে সরে যেত। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)

অর্থাৎ হৃদয়ের কোমলতা মানুষকে কাছে টানে।

হৃদয় সচেতনতার কেন্দ্রও। ওহি নাজিল হয় নবীজির হৃদয়ে। জিবরাঈল (আ.) ওহি নিয়ে আসেন হৃদয়ের ওপর, যাতে তিনি সতর্ককারী হন। (সুরা শুয়ারা, আয়াত: ১৯৩–১৯৪)

অর্থাৎ হৃদয়ই সচেতনতার দরজা।

আরও পড়ুন

হৃদয় রুচি ও স্বাদের জায়গা

হৃদয় রুচি ও স্বাদের জায়গা। এক আয়াতে বলা হয়েছে, যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না, আল্লাহর নাম শুনলে তাদের হৃদয় বিমুখ হয়, কিন্তু অন্যদের নাম শুনলে আনন্দিত হয়। (সুরা জুমার, আয়াত: ৪৫)

অর্থাৎ হৃদয় আনন্দ পায়, বিরক্ত হয় ও ভালোবাসে, এটি তার রুচির প্রকাশ।

পবিত্র কোরআনে হৃদয়কে শ্রবণ ও দৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। সুরা জাসিয়াতে (আয়াত: ২৩) বলা হয়েছে, যে তার খেয়াল–খুশিকে উপাস্য বানায়, আল্লাহ তার কান, হৃদয় সিল করে দেন, চোখে পর্দা ফেলে দেন। তখন কে তাকে পথ দেখাবে?

এখানে শ্রবণ, দৃষ্টি ও হৃদয়—এ তিনটি মানুষের মানবীয় বৈশিষ্ট্য। পশুরও কান–চোখ আছে, কিন্তু হৃদয়ের এই গভীরতা নেই। তাই হৃদয়ই মানুষকে মানুষ করে।

ইসলামের দৃষ্টিতে হৃদয় মানুষের নেতৃত্বের কেন্দ্র। চিকিৎসকেরা বলেন, হৃদয় রক্ত সঞ্চালন করে শরীরের চাহিদা মেটায়। কিন্তু ইসলাম বলছে, হৃদয় মানুষকে পথ দেখায়, হেদায়াত দেয়, আবার বিপথেও নিয়ে যায়।

সারকথা

ইসলামের দৃষ্টিতে হৃদয় মানুষের নেতৃত্বের কেন্দ্র। চিকিৎসকেরা বলেন, হৃদয় রক্ত সঞ্চালন করে শরীরের চাহিদা মেটায়। কিন্তু ইসলাম বলছে, হৃদয় মানুষকে পথ দেখায়, হেদায়াত দেয়, আবার বিপথেও নিয়ে যায়।

তাই হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন রাখা, আল্লাহর জিকিরে ভরিয়ে রাখা সবচেয়ে জরুরি। নবীজি (সা.) বলেছেন, শরীরে একটি গোশতের টুকরা আছে, সেটি ভালো হলে পুরো শরীর ভালো হয়, খারাপ হলে পুরো শরীর খারাপ হয়, সেটি হলো কলব বা হৃদয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,০৪৮)

এভাবে পবিত্র কোরআন হৃদয়কে মানুষের সবকিছুর কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরে। এটি শুধু শারীরিক অঙ্গ নয়, মন, বুদ্ধি, ইমান, অনুভূতি—সবকিছুর মূল। তাই হৃদয়কে জাগ্রত রাখতে হবে, এর রোগ থেকে বাঁচতে হবে। কারণ, হৃদয় অন্ধ হলে মানুষ পথ হারায়, হৃদয় জাগ্রত হলে সে আল্লাহর পথ পায়।

আরও পড়ুন