বাগদাদের জ্ঞানের বাতিঘর

প্রাচীন মুসতানসিরিয়া মাদ্রাসার ভবনছবি: উইকিপিডিয়া

আব্বাসীয় খিলাফত (৭৫০–১২৫৮ সাল) ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির এক অসাধারণ যুগ। এর কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাগদাদ। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইসলামি বিজ্ঞানের প্রসার এবং জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শন, ভাষাবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মতো বিভিন্ন শাখার সমন্বয়ের ফলে সুশৃঙ্খল শিক্ষার চাহিদা বেড়ে যায়।

মুসতানসিরিয়ার আগে বাগদাদে প্রায় ৩০টি মাদ্রাসা ছিল। তার মধ্যে নিজামিয়া মাদ্রাসা (১০৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত) ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (দাউদ, নাবিলা আবদুল মুনিম, আল-ইদারাতুত তারবাবিয়্যা ফিল মাদারিস ফিল আসরিল আব্বাসি, পৃ. ১৪, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০৮)

তবে মুসতানসিরিয়া তার বিশালতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কারণে পূর্বসূরিদের ছাড়িয়ে যায়।

রাজনৈতিকভাবেও মাদ্রাসাটির প্রতিষ্ঠা ছিল তখনকার খলিফার ক্ষমতা ও প্রভাবকে শক্তিশালী করার এক প্রচেষ্টার অংশ। খলিফা আল-মুসতানসির বিল্লাহ জ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহ পোষণ করতেন এবং প্রতিষ্ঠানটির উদ্বোধন ও তদারকিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। (ইবন আল-জাওযি, শামসুদ্দিন ইউসুফ, মিরআতুজ জামান, ৮/৭২৯, হায়দারাবাদ দখন, ১৯৫১-১৯৫২)।

মুসতানসিরিয়ার আগে বাগদাদে প্রায় ৩০টি মাদ্রাসা ছিল। তবে মুসতানসিরিয়া তার বিশালতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কারণে পূর্বসূরিদের ছাড়িয়ে যায়।
আরও পড়ুন
স্থাপত্যিক গুরুত্ব

মাদ্রাসায় ছিল ছাত্রদের জন্য থাকার ব্যবস্থা, একটি গ্রন্থাগার, একটি হাসপাতাল ও একটি মসজিদ। দজলা নদীর পূর্ব তীরে খলিফার প্রাসাদের বিপরীতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ১২২৭ থেকে ১২৩২ সালের মধ্যে নির্মিত হয় এবং ১২৩৪ সালে উদ্বোধন করা হয়। (আল-ফুতি, আবদুর রাজ্জাক বিন আহমদ, আল-হাওয়াদিস আল-জামিয়া ওয়াত তাজারিব আন-নাফিয়া ফিল মিয়াতিস সাবিয়া, পৃ. ৫৮, মাতবাআত আল-আনি, বাগদাদ, ১৯৫৯)

স্থাপত্য–পরিকল্পনায় মুসতানসিরিয়া মাদ্রাসা এক অসাধারণ কীর্তি। এর নকশা কার্যকারিতা ও নান্দনিকতার এক অনন্য সমন্বয় ঘটিয়েছিল। মাদ্রাসাটি ছিল একটি কেন্দ্রীয় উঠানের চারপাশে চারটি ইওয়ান (বড় খিলানযুক্ত হল) দ্বারা গঠিত, যা ইসলামি স্থাপত্যের একটি স্বীকৃত বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি ইওয়ান ছিল চারটি সুন্নি মাজহাবের (হানাফি, শাফেয়ি, মালিকি, হাম্বলি) শিক্ষার জন্য নিবেদিত। (আল-ফুতি, পৃ. ৫৬)

স্থাপত্যের জটিল টাইলকাজ, ক্যালিগ্রাফি আর জ্যামিতিক নিদর্শন প্রমাণ করে যে সেখানে শিল্পের বেশ কদর ছিল। ইতিহাসবিদ সিবত ইবন আল-জাওযি বর্ণনা করেছেন, ‘পৃথিবীতে আগে এ রকম কোনো কাঠামো নির্মিত হয়নি। অবয়ব, সুবিধা, হল, সজ্জা, অবস্থান ও ভূমির পরিমাণের দিক থেকে অত্যন্ত মার্জিতভাবে নির্মিত।’ (ইবন আল-জাওযি, শামসুদ্দিন ইউসুফ, মিরআতুজ জামান, ৮/৭২৯, হায়দরাবাদ দখন, ১৯৫১-১৯৫২)

মুসতানসিরিয়ার ভবন ছিল তখন আব্বাসীয় শাসনের গৌরব ও সমৃদ্ধির প্রতীক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিপুল জনসমাগম ঘটে। ৬ এপ্রিল, ১২৩৪ সালে (৫ রজব, ৬৩১ হিজরি) উদ্বোধন উপলক্ষে মন্ত্রী নাসিরুদ্দিন ইবন আল-নাকিদ, বিচারক, পণ্ডিত, কবি, সুফি এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে একটি বিশাল ভোজসভার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে নির্মাণকারী, কারিগর, গ্রন্থাগারিক এবং তাদের সহযোগীদের ‘শিক্ষাগত’ পোশাক প্রদান করা হয়। (আল-ফুতি, পৃ. ৫৫)

আরও পড়ুন
মাদ্রাসার একটি দেয়াল
ছবি: উইকিপিডিয়া
শিক্ষাব্যবস্থা

শিক্ষাব্যবস্থা ছিল এর সবচেয়ে উদ্ভাবনী দিক, যা ধর্মীয় ও পার্থিব বিজ্ঞানের এক অসাধারণ সমন্বয় ঘটিয়েছিল। ফলে মাদ্রাসাটি মুসলিম বিশ্বের প্রথম ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে কোরআন, হাদিস, ফিকহ, তাফসিরের পাশাপাশি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, সাহিত্য এবং উত্তরাধিকার বিজ্ঞান শেখানো হতো। (আল-ফুতি, আবদুর রাজ্জাক বিন আহমদ, আল-হাওয়াদিস আল-জামিয়া ওয়াত তাজারিব আন-নাফিয়া ফিল মিয়াতিস সাবিয়া, পৃ. ৫৮, মাতবাআত আল-আনি, বাগদাদ, ১৯৫৯)

এই বিস্তৃত পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীদের বহুমুখী জ্ঞানে দক্ষ করে তুলেছিল। শিক্ষকেরা ছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, যাঁরা বিতর্ক, আলোচনা, লিখিত নির্দেশনা এবং শ্রুতির মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন।

মাদ্রাসাটি চারটি সুন্নি মাজহাবের শিক্ষা দিত, প্রতিটি মাজহাবের জন্য ৬২ জন শিক্ষার্থী নির্বাচিত হতো এবং প্রতিটি বিভাগে একজন প্রধান শিক্ষক (শায়খ), চারজন সহকারী (মুয়িদ) এবং বিশেষজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ করা হতো। (আল-জাযারি, শামসুদ্দিন মুহাম্মদ, আল-মুখতার মিন তারিখ ইবন আল-জাযারি, পৃ. ১৫১, দার আল-কিতাব আল-আরবি, বৈরুত, ১৯৮৮)

মাদ্রাসাটি ছিল একটি কেন্দ্রীয় উঠানের চারপাশে চারটি ইওয়ান (বড় খিলানযুক্ত হল) দ্বারা গঠিত। প্রতিটি ইওয়ান ছিল চারটি সুন্নি মাজহাবের (হানাফি, শাফেয়ি, মালিকি, হাম্বলি) শিক্ষার জন্য নিবেদিত।

মুসতানসিরিয়ার চিকিৎসা বিদ্যালয়ও ছিল উল্লেখযোগ্য। এটি ১২৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর প্রধান চিকিৎসকের নিয়োগ খলিফার স্বাক্ষরে সম্পন্ন হতো। শিক্ষার্থীরা তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি পাশের হাসপাতালে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করত। (আবদুল ফাত্তাহ, নাহিদা, ইওয়ানুত তিব, পৃ. ১০, মাহরাজান আল-মুসতানসিরিয়া আল-আওয়াল, বাগদাদ, ১৯৮৫)

এই বিদ্যালয় বাগদাদে চিকিৎসাশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

ওয়াক্‌ফ ব্যবস্থা

শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে শিক্ষা ও থাকার ব্যবস্থার সঙ্গে ভাতাও প্রদান করা হতো, যা ওয়াক্‌ফ (দান) ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থায়ন করা হতো। (আল-গাসানি, আবুল আব্বাস ইসমাইল, আল-আসজাদ আল-মাসবুক ওয়াল জাওহার আল-মাহকুক, পৃ. ৪৫৮, দার আল-বায়ান, বাগদাদ, ১৯৭৫)

মুসতানসিরিয়ার আর্থিক ভিত্তি ছিল এর বিশাল ওয়াক্‌ফ ব্যবস্থা। ইতিহাসবিদ ইমাম জাহাবি উল্লেখ করেছেন, তিনি এর ওয়াক্‌ফের পাঁচ খণ্ডের রেকর্ড দেখেছিলেন, যার মধ্যে বাগদাদের বিভিন্ন মহল্লা, দোকান এবং দুজাইল ও নাহর ইসা অঞ্চলের বৃহৎ ও ক্ষুদ্র গ্রামগুলোর সম্পত্তি অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার মোট মূল্য ছিল প্রায় ৯০০,০০০ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)। (আল-জাহাবি, মুহাম্মদ বিন আহমদ, তারিখুল ইসলাম, ৬৪/৭, মুয়াস্‌সাসাতুর রিসালাহ, বৈরুত, ১৯৮৮)

এই ওয়াক্‌ফ প্রায় ৫০০ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মীদের জীবিকা নির্বাহ করত। ওয়াক্‌ফের মাধ্যমে শিক্ষকদের মাসিক ১২ দিনার, ২০ পাউন্ড রুটি এবং ৫ পাউন্ড মাংস; সহকারীদের ৩ দিনার এবং ৭ পাউন্ড রুটি; এবং শিক্ষার্থীদের ১ দিনার, ৪ পাউন্ড রুটি, রান্না করা খাবার, মিষ্টি, ফল, সাবান এবং বিছানাপত্র প্রদান করা হতো। (আল-জাযারি, পৃ. ১৫০)

এই ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রার উদ্বেগ থেকে মুক্ত রেখে শিক্ষায় মনোনিবেশ করতে সক্ষম করেছিল।

আরও পড়ুন
মাদ্রাসার চত্বর
ছবি: উইকিপিডিয়া
গ্রন্থাগার

গ্রন্থাগারটি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বলা যায়, মুসতানসিরিয়ার গ্রন্থাগার ছিল এর শিক্ষাব্যবস্থার মূল শক্তি। সেখানে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপি ছিল প্রায় ৮০ হাজার। শুধু ধর্মীয় নয়, ইহলৌকিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার জ্ঞান সংরক্ষণ ও প্রচারেও এসব বই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। (ইবন ইনাবা, আহমদ বিন আলী, উমদাতুত তালিব ফি আনসাব আলি আবি তালিব, পৃ. ২০৬, মাতবাআত আল-হায়দারি, নাজাফ, ১৯৬১)

ইবন আল-ফুতি উল্লেখ করেছেন, খলিফা আল-মুসতানসির নিজস্ব সংগ্রহ থেকে মূল্যবান পাণ্ডুলিপিগুলো এই গ্রন্থাগারে স্থানান্তরিত হয়, যা ১৬০ জন লোকের মাধ্যমে বহন করে আনতে হয়েছে। (আল-ফুতি, পৃ. ৫৩)

গ্রন্থাগারে একজন খাজিন (গ্রন্থাগারিক), মুশরিফ (তত্ত্বাবধায়ক), নাসিখ (নকলকারী), মুনাওয়িল (গ্রন্থ সরবরাহকারী), বই বাঁধাইকারী এবং অনুবাদক নিয়োজিত ছিলেন, যাঁরা গ্রন্থাগারের ব্যবস্থাপনা ও পাঠকদের সুবিধা নিশ্চিত করতেন। (আল-সুবকি, আবদুল ওয়াহাব, মুঈদুন নিয়াম ওয়া মুবিদুন নিকাম, পৃ. ১৩১, দার আল-জিল, কায়রো, ১৯৬৪)

খলিফা আল-মুসতানসির নিজস্ব সংগ্রহ থেকে মূল্যবান পাণ্ডুলিপিগুলো এই গ্রন্থাগারে স্থানান্তরিত হয়, যা ১৬০ জন লোকের মাধ্যমে বহন করে আনতে হয়েছে।
দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব

মুসতানসিরিয়া মাদ্রাসা ইসলামি শিক্ষার ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এর শিক্ষাব্যবস্থা এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পরবর্তী শতাব্দীতে মিসর, সিরিয়া ও উত্তর আফ্রিকার মাদ্রাসাগুলোর জন্য মডেল হিসেবে কাজ করে। এটি পার্থিব ও ধর্মীয় জ্ঞানের সমন্বয়ের একটি নজির স্থাপন করে, যা ইসলামি শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুসতানসিরিয়া থেকে বহু পণ্ডিত, চিকিৎসক, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং ক্যালিগ্রাফার স্নাতক হয়েছেন, যাঁরা মুসলিম সভ্যতার জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। (মারুফ, নাজি, তারিখ উলামা আল-মুসতানসিরিয়া, ১/৪২, মাতবাআত আল-আনি, বাগদাদ, ১৯৫৯)

১২৫৮ সালে মঙ্গল আক্রমণে বাগদাদ ধ্বংস হলেও মুসতানসিরিয়া টিকে থাকে এবং পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। (আল-জাহাবি, পৃ. ৭)

মঙ্গল আক্রমণের পর কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এর ওয়াক্‌ফ ব্যবস্থা শিক্ষা ও গবেষণার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য সম্পদ হিসেবে টিকে থাকে। আধুনিক সময়ে মুসতানসিরিয়া ইরাকের একটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে সংরক্ষিত আছে এবং সভ্যতার গৌরবময় অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলছে।

আরও পড়ুন