আবু হামিদ মুহাম্মদ আল-গাজ্জালি। জন্ম তাঁর খোরাসানের তুস শহরে, হিজরি ৪৫০ সালে। তাঁর বাবা ছিলেন খুব গরিব। পশমের সুতা বুনে তাঁর সংসার চলত। তুস শহরে নিজের ছোট্ট একটি দোকানে বসে তিনি সুতা কাটতেন; আর সেই সুতা বেচে যা আয় হতো, তা দিয়েই দিন কাটাতেন। নিজের রোজগার করা পয়সা ছাড়া তিনি একটি দানাও মুখে তুলতেন না, পরিবারের সদস্যদের মুখেও দিতেন না।
ধর্মের প্রতি ইমাম গাজ্জালির বাবার টান ছিল গভীর। জ্ঞানী, পণ্ডিত আর আলেমদের আসরে তিনি প্রায়ই যেতেন। তাঁদের সেবা করার জন্য ব্যাকুল থাকতেন। নিজের সাধ্যমতো তাঁদের দেখভাল করতেন ও খেয়াল রাখতেন।
তাঁদের কথা আর উপদেশ শুনে তাঁর চোখে পানি এসে যেত। তখন তিনি দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে আকুল হয়ে চাইতেন, যেন তিনি এমন একটি ছেলে তাঁকে দেন, যে হবে ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শী, দীনের রক্ষক।
আল্লাহ ইমাম গাজ্জালির বাবার এই প্রার্থনা কবুল করলেন। তিনি দুটি পুত্রসন্তান লাভ করেন। একজনের নাম রাখলেন মুহাম্মদ, আরেকজনের নাম আহমদ। ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজের অপূর্ণ স্বপ্নের ছায়া দেখতে পেতেন। আশা করতেন, তাঁর প্রার্থনা কবুল হবে আর তাঁর ছেলেরা একদিন বড় জ্ঞানী হয়ে উঠবে।
কিন্তু মৃত্যু ইমাম গাজ্জালির বাবাকে অবকাশ দিল না। ছেলেরা তখন নিতান্তই ছোট। মারা যাওয়ার ঠিক আগে, তিনি ছেলেদের ভার তুলে দিলেন এক দরবেশ বন্ধুর হাতে। তাঁর সেই বন্ধু ছিলেন বড় সৎ এবং আল্লাহভক্ত।
বাবার মৃত্যুর পর সেই দরবেশ বন্ধু ছেলে দুটির পড়াশোনার সব দায়িত্ব নিলেন। যথাসম্ভব চেষ্টা করতে লাগলেন; কিন্তু বাবার সামান্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল, তা ফুরিয়ে গেল। দরবেশ নিজেও ছিলেন গরিব।
বন্ধুকে ইমাম গাজ্জালির বাবা বলে গেলেন, ‘আমার জীবনে একটাই বড় দুঃখ রয়ে গেল। দ্বীনের জ্ঞান লাভ করা আমার ভাগ্যে হলো না। তবে আমি আশা করি, আমার যা পাওয়া হয়নি, তা আমার এই দুই ছেলের মাধ্যমে পূর্ণ হবে। তুমি তোমার সাধ্যমতো ওদের জ্ঞানদান কোরো। ওদের জন্য জ্ঞানের পথ সহজ করে দিয়ো। এর জন্য যদি আমার রেখে যাওয়া সব সম্পত্তি খরচ হয়ে যায়, তাহলেও দ্বিধা কোরো না।’
বাবার মৃত্যুর পর সেই দরবেশ বন্ধু ছেলে দুটির পড়াশোনার সব দায়িত্ব নিলেন। যথাসম্ভব চেষ্টা করতে লাগলেন; কিন্তু বাবার সামান্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল, তা ফুরিয়ে গেল। দরবেশ নিজেও ছিলেন গরিব, কোনোমতে তাঁর দিন কাটত।
তখন দরবেশ ছেলে দুটিকে বললেন, ‘শোনো, তোমাদের বাবার রেখে যাওয়া সব টাকা আমি তোমাদের পেছনে খরচ করে ফেলেছি। আর তোমরা তো দেখছই, আমি এক কপর্দকশূন্য গরিব মানুষ। তোমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো অতিরিক্ত কোনো টাকা আমার কাছে নেই। আমার মতে, তোমাদের কোনো মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া উচিত। সেখানে থাকলে তোমাদের দুই বেলা খাবার আর পড়াশোনা, দুটিই জুটবে।’
তাঁরা তা–ই করলেন। (সুবকি, তাবাকাতুশ শাফিঈয়্যাহ, ৬/১৯৩-১৯৪)
এদিকে আবু হামিদ ইমাম গাজ্জালি নিজেকে পুরোটাই সঁপে দিলেন ধর্মীয় জ্ঞান ও শাস্ত্রের মধ্যে। অসীম ধৈর্য আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে তিনি পড়তে লাগলেন, আত্মস্থ করতে লাগলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তাঁর সব সহপাঠীকে ছাড়িয়ে গেলেন। সবার কাছে তিনি হয়ে উঠলেন ‘জীবন্ত বিস্ময়’।
আর ইমাম গাজ্জালির ভাই আহমদ বেছে নিলেন সাধনার পথ। দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন ইবাদত-বন্দেগিতে। ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠলেন। তাঁর কথা বলার ধরন ছিল চমৎকার, আর তাঁর দেওয়া উপদেশ মানুষের মন ছুঁয়ে যেত। (ইবনুল ইমাদ, শাযারাতুয যাহাব, ৪/৬০)
প্রথম দিকে গাজ্জালি গেলেন জুরজানে। তুসের কাছেই ছোট্ট একটি শহর। সেখানে তিনি ইমাম আবু নসর ইসমাইলির কাছে পড়াশোনা শুরু করলেন। তাঁর কাছে তিনি নানা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতেন; আর নিজের খাতায় সযত্নে তা টুকে রাখতেন।
এরপর তিনি এলেন নিশাপুরে। সেখানে তিনি ইমামুল হারামাইন জুওয়াইনির শিষ্যত্ব নিলেন। শুরু হলো তাঁর অক্লান্ত সাধনা। অল্প দিনেই তিনি ফিকহ, উসুলুল ফিকহ, ধর্মতত্ত্ব, তর্কবিদ্যা ও দর্শনে অসামান্য পাণ্ডিত্য লাভ করলেন।
অল্প দিনেই ইমামুল হারামাইনের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল। গুরু নিজেও শিষ্যকে নিয়ে গর্ব করতেন। তিনি বলতেন, ‘গাজ্জালি এক অতল সাগর।’ যদিও কেউ কেউ বলেন, ভেতরে ভেতরে তিনিও নাকি গাজ্জালির এই অসাধারণ প্রতিভাকে ঈর্ষা করতেন।
এ সময়টা ছিল গাজ্জালির জ্ঞানচর্চার স্বর্ণযুগ। তিনি তখন একদিকে যুক্তিশাস্ত্র, অন্যদিকে ধর্মতত্ত্ব—উভয় ধারায়ই একের পর এক বই লিখে চলেছেন। ইমাম সুবকী তাঁর এই খ্যাতির কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন, গাজ্জালির ছিল প্রখর ধীশক্তি, স্বচ্ছ বিচারবোধ আর গভীর অন্তর্দৃষ্টি। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ, আর কঠিন বিষয়কে সহজ করে বোঝানোর অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। (সুবকী, তাবাকাতুশ শাফিঈয়্যাহ, ৬/১৯৬)
আমি ইমাম গাজ্জালিকে মরুপ্রান্তরে একাকী ঘুরে বেড়াতে দেখেছিলাম। হাতে একটি লাঠি, পরনে তালি দেওয়া পোশাক, আর কাঁধে একটা জলের পাত্র।বিখ্যাত মালিকি আলেম আবু বকর ইবনুল আরাবি
গুরুর মৃত্যুর পর গাজ্জালি নিশাপুর ছাড়লেন। তিনি উজির নিজামুল মুলকের দরবারে গেলেন। তাঁর দরবার ছিল তখন জ্ঞানী-গুণীদের কেন্দ্র। সেখানে অনেক বড় বড় পণ্ডিতের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক হলো। তিনি সবাইকে যুক্তিতে পরাস্ত করলেন। তাঁর জ্ঞান, যুক্তি আর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে নিজামুল মুলক তাঁকে বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসার প্রধান অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করলেন। সেই যুগে নিজামিয়া ছিল মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়।
বাগদাদে অধ্যাপনা করার সময় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর খ্যাতি। বিশেষ থেকে সাধারণ, সবার কাছেই তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠলেন। তাঁর নাম হয়ে উঠল অগাধ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উপমা। দেশ-বিদেশ থেকে ছাত্ররা আসতে লাগল তাঁর কাছে জ্ঞানলাভের জন্য। আর তাঁর লেখা বইপত্র ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। (ইবনুল ইমাদ, শাযারাতুয যাহাব, ৪/১২)
সেই দিনগুলোতে গাজ্জালি খ্যাতির স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলেন। নাম-যশের মোহ, প্রতিপক্ষকে হারানোর তীব্র বাসনা তাঁর অবচেতন মনে বাসা বাঁধছিল। নিজের আত্মজীবনীমূলক ‘আল-মুনকিজ মিনাদ দালাল’ বইয়ে তিনি অকপটে এ কথা স্বীকারও করেছেন। নিজের পাণ্ডিত্যে তিনি তখন গর্বিত; আর বিরোধীদের দেখতেন কিছুটা তাচ্ছিল্যের চোখে।
তবে এটা ছিল ইমাম গাজ্জালির বাবার আত্মসমালোচনা। নিজের ভেতরকে পুরোপুরি বিশুদ্ধ করার প্রচণ্ড তাড়নার এক আত্ম-উপলব্ধি। এই খ্যাতির জীবনেও তিনি ছিলেন সত্যের একনিষ্ঠ সেবক আর ধর্মের এক অকুতোভয় রক্ষক। অকাট্য যুক্তি দিয়ে তিনি মানুষের মধে৵ সংশয়ের মেঘ কাটিয়ে দিতেন। ইসলামের বিশ্বাসকে নানা দার্শনিক মতবাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতেন। এক কথায় বলতে গেলে স্বয়ং আল্লাহই যেন তাঁর কণ্ঠ, তাঁর ভাষা আর তাঁর জ্ঞানকে ধর্মের রক্ষাকবচ হিসেবে তৈরি করেছিলেন। বানিয়েছিলেন তাঁকে ইসলামের অকাট্য প্রমাণ, হুজ্জাতুল ইসলাম।
একদিন হঠাৎ এই সবকিছুর ওপর ইমাম গাজ্জালির মনে এক তীব্র বিতৃষ্ণা জন্মাল। যে জীবন তাঁকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল, সেই জীবনটাই তাঁর কাছে অসহ্য মনে হতে লাগল। যে সম্মান, যে খ্যাতি একদিন তাঁর বাসনা ছিল, তা একমুহূর্তে বিষের মতো লাগল।
একঝটকায় তিনি সব ছেড়ে দিলেন। ত্যাগ করলেন তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের আসন। পরলেন ফকিরের পোশাক। মিশে গেলেন সাধারণ মানুষের ভিড়ে। মুখ ফেরালেন নিজামিয়া থেকে, তার চাকচিক্য থেকে। বেরিয়ে পড়লেন মক্কার পথে হজ করবেন বলে। তখন তাঁর ৩৮ বছর বয়স।
এরপর ইমাম গাজ্জালি গেলেন জেরুজালেমে। সেখান থেকে ফিরে এসে থিতু হলেন দামেস্কে। উমাইয়া মসজিদের পশ্চিম মিনারের নিচের এক কুঠুরিতে তিনি থাকতে শুরু করলেন। মাঝেমধ্যে একাকী উঠে যেতেন একেবারে চূড়ায়।
প্রায় ৯ বছর তিনি নিজের জন্মভূমি থেকে দূরে ছিলেন। এর বেশির ভাগটাই কেটেছে দামেস্কে, এক সাধারণ গরিব মানুষের ছদ্মবেশে। আর এ সময়েই তিনি রচনা করছিলেন তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন’।
যখনই তিনি টের পেতেন, চারপাশের মানুষ তাঁর জ্ঞান বা ব্যক্তিত্বের আঁচ পেতে শুরু করেছে, তাঁর পরিচয় আবার ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছে, অমনি তিনি সেই জায়গা, এমনকি পুরো শহর থেকেই বিলকুল গায়েব হয়ে যেতেন। কিছুদিন পর আবার ফিরতেন, আরও দীনহীন, আরও ফকিরের বেশে। লোকে তত দিনে তাঁর কথা ভুলে যেত।
তখন তিনি আবার ডুব দিতেন ইবাদতে, আল্লাহর জিকিরে। নিজের আত্মাকে শুদ্ধ করার কঠোর সাধনায় মগ্ন হতেন। অহংকার থেকে, আত্মমুগ্ধতা থেকে নিজেকে পবিত্র করতেন। আর ধীরেসুস্থে এগিয়ে চলত তাঁর ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন লেখার কাজ।
বিখ্যাত মালিকি আলেম আবু বকর ইবনুল আরাবি বলেন, ‘আমি ইমাম গাজ্জালিকে মরুপ্রান্তরে একাকী ঘুরে বেড়াতে দেখেছিলাম। হাতে একটি লাঠি, পরনে তালি দেওয়া পোশাক, আর কাঁধে একটা জলের পাত্র। অথচ আমিই নিজ চোখে তাঁকে বাগদাদে দেখেছিলাম বেশ আগে। প্রায় চার শতেক সেরা জ্ঞানীগুণী মানুষ তাঁর দরবারে বসতেন। তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান নিতেন।’
আমি ইমাম গাজ্জালির কাছে গেলাম। সালাম দিলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে ইমাম, এই জীবনের চেয়ে বাগদাদের সেই জ্ঞানচর্চার দিনগুলো কি ভালো ছিল না?’
ইমাম গাজ্জালি আমার দিকে আড়চোখে তাকালেন। তারপর বললেন: ‘আমার ইচ্ছাশক্তির আকাশে যখন সৌভাগ্যের চাঁদ উঠল, আর সত্যকে পাওয়ার সূর্যটা অস্তাচলে গেল, তখন—
আমি লায়লা আর সুআদার মোহ একপাশে সরিয়ে রাখলাম,/আর ফিরে এলাম আমার প্রথম ঘরের সেই চিরচেনা সঙ্গীর কাছে।/ওদের জন্য কত মিহি সুতা বুনেছিলাম আমি,/কিন্তু সেই সুতার কোনো কারিগর পেলাম না।/তাই নিজের চরকাটাই ভেঙে ফেললাম।/তখন আকুল আকাঙ্ক্ষা আমায় ডেকে বলল, ধীরে, আরও ধীরে.../এই তো তোমার প্রেমাস্পদের ঠিকানা। শান্ত হও। এবার প্রবেশ করো।’ (ইবনুল ইমাদ, শাযারাতুয যাহাব, ৪/১২)
এরপর একদিন ইমাম গাজ্জালি ফিরলেন নিজের ঘরে, নিজের জন্মভূমি তুসে। এখানে এসে তিনি আল্লাহর স্মরণ আর গভীর চিন্তায় নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন। এই নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে শেষ যাত্রার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলেন।
ইমাম গাজ্জালি ঘরের দরজা খোলা রইল সবার জন্য। মানুষ আসত উপদেশ চাইতে, শিখতে বা শুধু দেখা করতে। কাউকেই তিনি ফেরাতেন না। এই সময়েই তাঁর লেখা বইগুলো আরও বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছতে লাগল। বিশেষ করে তাঁর ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন আর আল-আরবাইন ফি উসুলিদ দীন।
‘সোমবার ভোরবেলা। আমার ভাই আবু হামিদ অজু করলেন, নামাজ পড়লেন। তারপর বললেন, ‘আমার কাফনের কাপড়টা নিয়ে এসো।’ কাপড়টা হাতে নিয়ে তিনি তাতে চুমু খেলেন।
সেই সময়কার উজির খোরাসান থেকে এলেন সোজা তাঁর কাছে। গাজ্জালির সঙ্গে দেখা করে, তাঁর কথা শুনে আর তাঁর উপদেশ পেয়ে উজির মুগ্ধ হলেন। তিনি গাজ্জালিকে বারবার অনুরোধ করলেন। প্রায় জোর করেই বলতে লাগলেন, যেন তিনি তাঁর জ্ঞানকে এভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে নিঃশেষ হয়ে যেতে না দেন। তিনি জোর দিয়ে প্রস্তাব রাখলেন, গাজ্জালি যেন আবার নিশাপুরে ফিরে যান। সেখানকার নিজামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপনা শুরু করেন।
শাসকের আদেশ বলে কথা। গাজ্জালি তা ফেরাতে পারলেন না। তিনি আবার ফিরে গেলেন অধ্যাপনার জীবনে। আবার শুরু করলেন ছাত্রদের শেখানো, তাদের পথের দিশা দেখানো। কিন্তু এবার তিনি অন্য মানুষ। খ্যাতির মোহ, সহকর্মীদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক, বিরোধীদের সঙ্গে অহেতুক বিবাদ, যেসব তিনি একদিন পেছনে ফেলে এসেছিলেন, সেদিকে আর ফিরেও তাকালেন না।
আবদুল গাফির ফারসি বলেন, ‘গালি যখন নিশাপুরের নিজামিয়ায় ফিরে এলেন, আমি বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমি খুঁজছিলাম সেই পুরোনো মানুষটাকে। একসময় তাঁর মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস আর নিজস্বতার গর্ব ছিল, সমসাময়িক ব্যক্তিদের প্রতি যে অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল, আমি সেটিই দেখতে চেয়েছিলাম। কারণ, তাঁর ছিল অসাধারণ বাগ্মিতা, গভীর জ্ঞান, প্রখর বুদ্ধি আর সুন্দর করে কথা বলার এক সহজাত ক্ষমতা।
কিন্তু আমি দেখলাম, ইমাম গাজ্জালি পুরোপুরি বদলে গেছেন। তিনি হয়ে উঠেছেন অমায়িক, নরম, বিনয়ী। সেই সব আবিলতা থেকে তিনি এখন সম্পূর্ণ মুক্ত।
আমরা ইমাম গাজ্জালিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তিনি আবার এই পথে ফিরে এলেন? কেন নিশাপুরের নিজামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপনা করতে রাজি হলেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘ধর্মের প্রচার বন্ধ করে দেওয়া, জ্ঞানপিপাসুদের উপকার করা থেকে বিরত থাকা, ধর্মে এর অনুমতি নেই। সত্যকে প্রকাশ করা, সত্যের কথা বলা আর সত্যের দিকে মানুষকে ডাকা, এটাই এখন আমার অবশ্য কর্তব্য’।’ (ইবনে আসাকির, তাবইনু কাযিবিল মুফতারি, ২৯৪-২৯৫)
কিছুদিন পর ইমাম গাজ্জালি নিশাপুরের নিজামিয়া থেকেও বিদায় নিলেন। ফিরে এলেন তুসে, নিজের বাড়িতে। বাড়ির পাশেই তিনি ছাত্রদের জন্য একটি মাদ্রাসা আর সুফিদের জন্য একটি খানকাহ তৈরি করলেন।
ইমাম গাজ্জালির দিনগুলো কেটে যেত সুচারুরূপে। তিনি কোরআন পড়তেন, জ্ঞানী-গুণী সাধকদের সঙ্গে সময় কাটাতেন, ছাত্রদের পড়াতেন। বাকি সময়টা হাদিস চর্চা করতেন। বুখারি আর মুসলিম শরিফ পাঠে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন। ইমাম জাহাবি বলেন, তিনি যদি আর কিছুদিন বাঁচতেন, তবে খুব অল্প সময়েই হাদিস শাস্ত্রে সবাইকে ছাড়িয়ে যেতেন। (যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৯/৩২৫-৩২৬)
কিন্তু মৃত্যু ইমাম গাজ্জালিকে সেই সুযোগ দিল না। ৫৫ বছর বয়সে এক সোমবার এই দুনিয়া থেকে তিনি বিদায় নিলেন।
সেই দিনটা সম্পর্কে ইমাম গাজ্জালির ভাই আহমদ বলেন: ‘সোমবার ভোরবেলা। আমার ভাই আবু হামিদ অজু করলেন, নামাজ পড়লেন। তারপর বললেন, ‘আমার কাফনের কাপড়টা নিয়ে এসো।’ কাপড়টা হাতে নিয়ে তিনি তাতে চুমু খেলেন। নিজের চোখের ওপর রাখলেন। তারপর বললেন, ‘শুনলাম এবং মানলাম। মালিকের দরবারে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত।’ এই বলে তিনি পা ছড়িয়ে দিলেন, কেবলার দিকে মুখ ফেরালেন। দিনের আলো ফোটার আগেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। আল্লাহ তাঁর আত্মাকে শান্তি দিন।’ (সুবকী, তাবাকাতুশ শাফিঈয়্যাহ, ৬/২০১)
আবদুল্লাহিল বাকি : লেখক, আলেম ও সফটওয়্যার প্রকৌশলী