হজরত শোয়াইব (আ.)-এর কন্যা বিয়ে দিলেন হজরত মুসা (আ.)-কে

পবিত্র কোরআনে সুরা আরাফ, হুদ ও শুআরায় বিস্তারিতভাবে এবং সুরা হিজর ও আনকাবুতে সংক্ষিপ্তভাবে হজরত শোয়াইব (আ.) এবং তাঁর কওমের বর্ণনা করা হয়েছে। কোরআনের মোট ১০টি স্থানে ‘শোয়াইব’ নামটি পাওয়া যায়। শোয়াইব (আ.)–এর আগমনকাল নির্দিষ্ট করে লিখিত পাওয়া যায় না। তবে কোরআনের বর্ণনামতে স্পষ্টই বোঝা যায় যে তিনি হজরত মুসা (আ.)–এর সামান্য কিছুকাল আগে আগমন করেন। যেহেতু হজরত মুসা (আ.)–এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের বিষয়টি এবং তাঁর সঙ্গে মুসা (আ.)-এর দীর্ঘকাল কাটানো, তাঁর কন্যার সঙ্গে বিবাহ সম্পর্কে জড়ানোর ঘটনায় সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

যেই কুয়া থেকে শোয়াইব (আ.)-এর কন্যাদের হজরত মুসা (আ.) পানি তুলে দিয়েছিলেন, তা বর্তমানে ‘মাগায়েরে শোয়েব’ এলাকা থেকে পাঁচ-ছয় শ মিটার দূরে অবস্থিত। এ কুয়ার পানি হজরত শোয়াইব (আ.)-এর আমলে মাদায়েনবাসী ব্যবহার করতেন। বিরে শোয়েব বা শোয়েব নবীর কূপটি সেখানে এখনো কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা আছে। অতীতে বেদুইনরা তাদের উট ও ছাগলের জন্য পানি সংগ্রহ করতে এখানে জড়ো হতো। কোরআনে রয়েছে শোয়াইব (আ.) তখন মুসা (আ.)–কে বললেন, আমার এ দুই মেয়ের একজনকে তোমার কাছে বিয়ে দিতে চাই, এ শর্তে যে তোমাকে আমার এখানে আট বছর চাকরি করতে হবে। আর যদি ১০ বছর পূর্ণ করো, তাহলে তা তোমার ইচ্ছা।...মুসা (আ.) জবাবে বললেন, আমার ও আপনার মধ্যে একথা ঠিক হয়ে গেল। (সুরা কাসাস, আয়াত: ২৬-২৮)

সম্ভবত মেয়ের বিয়ের সময়েই বৃদ্ধ শোয়াইব (আ.) তাঁর হাতের লাঠি উপহার দিয়েছিলেন মুসা (আ.)–কে। সে অঞ্চলের প্রাচীন রীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কন্যা বিয়ে দেওয়ার নিদর্শন হিসেবে এখনো সেখানে জামাতাকে হাতের যষ্ঠী বা খঞ্জর উপহার দেওয়ার প্রচলন রয়েছে।

আরও পড়ুন

হজরত মুসা (আ.)-এর সময়কাল অনুমান করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৯২ থেকে ১২৭২ সালকে, যখন মিসরের ফেরআউন বা ফারাও ছিল ‘কাবুস’; যাকে স্মরণ করা হয় দ্বিতীয় রামেসিস নামে। সে হিসেবে কেউ কেউ মনে করেন, হজরত শোয়াইব (আ.)-এর সময় হলো ১৪৫০ থেকে ১৩১০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ; যখন সে এলাকায় আশুরীয়দের রাজা ইউসামের পিতা আহাজের রাজত্ব চলছিল। তবে এতটুকু নিশ্চিত করে বলা যায় যে মুসা (আ.) তাঁর গোত্র নিয়ে লোহিত সাগর পার হয়ে আসার পরে অর্থাৎ ফেরাউন বাহিনী লোহিত সাগরে ডুবে মরার পরে যখন আবার মাদায়েনে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরে আসেন, সে সময় শোয়াইব (আ.) বেঁচে ছিলেন না। তাই হজরত শোয়াইব (আ.) যেখানে আবির্ভাব লাভ করেন, ইতিহাসের সব সূত্রমতেই সে স্থানটি হলো মাদায়েন। কোরআনে অবশ্য বলা হয়েছে মাদইয়ান। আর বাইবেলের টেক্সটে এসেছে মিদয়ান হিসেবে। পরবর্তী সময়ে হজরত শোয়াইবের (আ.) আগমনের কারণেই সে স্থান একসময় ‘মাগায়েরে শোয়েব’ নামে পরিচত হয়।

আরও পড়ুন

মাদায়েন বা মাগায়েরে শোয়েব প্রাচীন ঐতিহাসিক জনপদ। আধুনিক পৌর নাম আল-বেদ। সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিমের এই আল-বেদ এক সময় হেজাজ ও ইয়েমেন-সিরিয়া আর পারস্য উপসাগর থেকে মিশর পর্যন্ত দুটি রাজপথের মধ্যে যোগাযোগের কেন্দ্র ছিল। আরব উপদ্বীপের এই সমৃদ্ধ এলাকা পরিচিত ছিল মাদায়েন নামে। এ শহরে নানা দেশের কাফেলার মিলন ঘটত। আবার এখান থেকে একে অন্যের কাছে বিদায় নিতেন। এ জন্যই হয়তো বা এ স্থানের নাম আল-বেদা বা আল-বেদ হয়েছে বলে ধারণা করা যায়।

মাদায়েনের ইতিহাস বেশ কজন নবী-রাসুলের সঙ্গে যুক্ত। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর তৃতীয় স্ত্রী কাতুরার গর্ভজাত সন্তানেরা আরব ও ইসরায়েলের ইতিহাসে বনি কাতুরা নামে পরিচিত হয়েছেন। কাতুরার এক ছেলে হলেন মাদইয়ান বিন ইবরাহিম। মাদইয়ানের বংশধরেরা ইতিহাসে পরিচিত হন আসহাবে মাদইয়ান নামে। তাঁরা হেজাজ থেকে ফিলিস্তিনের দক্ষিণ এলাকা পর্যন্ত বসতি স্থাপন করেন। সেখান থেকে সিনাই উপত্যকার শেষভাগে আকাবা উপসাগর ও লৌহিত সাগরের তটরেখা ছুঁয়ে তারা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েন। মাদায়েন শহর ছিল তাদের প্রধান কেন্দ্রভূমি। কাতুরার অন্য ছেলেরা উত্তর আরবের তাইমা, তাবুক এবং আল উলার মধ্যবর্তী এলাকায় বসতি বিস্তার করেন। বিখ্যাত দিদানি সভ্যতার অধিকারী দিদান জাতি তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। বনু কাতুরার এই অংশের প্রধান কেন্দ্র ছিল তাবুক বা প্রাচীনকালের আইকাহ। প্রাচীন উৎস গ্রন্থাবলিতে তাবুকের প্রাচীন নাম আইকাহ বলা হয়েছে।

ইবনে ইসহাকের বর্ণনামতে, হজরত শোয়াইব (আ.) ছিলেন ইবরাহিম (আ.)-এর পুত্র মাদইয়ানের বংশধর। কোনো কোনো বর্ণনামতে, হজরত শোয়াইব (আ.) ছিলেন হজরত সালেহ (আ.)-এর বংশধর। যেহেতু মাদইয়ান জাতির কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন, তাই পরবর্তী সময়ে তাঁর নামেই তাঁর কওম বা জাতির নামকরণ করা হয় কওমে শোয়াইব।

আরও পড়ুন

ধারণা করা হয়, বর্তমান সিরিয়ার মুয়ান বা মায়ান নামক স্থানে কওমে শোয়াইবের বসবাস ছিল। হেজাজ থেকে সিরিয়া-ফিলিস্তিন এমনকি মিসর পর্যন্ত যাওয়ার সময় আইকাবসীর ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ে, যা তাবুকের বিপীত দিকে অবস্থিত পবিত্র কোরআনে কোথাও ‘আসহাবে মাদইয়ান’ আবার কোথাও ‘আহলে মাদইয়ান’ নামে তাদের অভিহিত করা হয়েছে। আবার কোথাও ‘আসহাবে আইকা’ও বলা হয়েছে তাদের। কারও কারও মতে, আসহাবে আইকা ও মাদইয়ান দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়। তবে অধিকাংশ তাফসিরকারক আসহাবে আইকা ও মাদইয়ান একই সম্প্রদায় বলে মনে করেন। যাদের পিতার দিকে সম্বোধন করে মাদইয়ান বলা হতো, আর ভৌগোলিক দিক থেকে আইকা বলা হতো। আইকা শব্দটির অর্থ হলো বন-জঙ্গল। এ জায়গার মাটি উর্বর হওয়ায় সে স্থানে ফলফলাদিসহ বিভিন্ন প্রকার বৃক্ষরাজি বেশি হতো। এদিক বিবেচনা করেই তাদের আসহাবে আইকা বলার অবকাশ রয়েছে। এভাবেও বলা যেতে পারে যে মাদায়েন ও আইকার অধিবাসীরা আদিতে ছিলেন একই বংশের লোক। তাদের ভাষাও অভিন্ন ছিল। সম্ভবত কোনো কোনো এলাকায় তারা একসঙ্গে বাস করতেন। বিয়েশাদির মাধ্যমে বনি কাতুরার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার মধ্যে অভিন্ন সমাজও গড়ে উঠেছিল।

আরও পড়ুন