জামারায় পাথর মেরে, বাইকে মক্কা

পবিত্র হজফাইল ছবি: এএফপি

মুজদালিফার স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে আমরা এলাম জামারা স্টেশনে যেটা আবার মিনার তৃতীয় স্টেশন। ট্রেন থেকে নেমে একটু এগোতেই পানির সন্ধান মিলল। দলে দলে হাজিরা এগিয়ে চলেছেন তালবিয়া পড়তে পড়তে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে ঝকঝকে সূর্যের আলোয় জামারা অভিমুখী প্রশস্ত হাঁটার পথ ধরে আমরার সামনে যেতে থাকলাম। শ্বেতশুভ্র জনস্রোতের মাঝে নিজেদের যেন ভাসিয়ে দিলাম। সবার মাঝেই যেন এক অনির্বচনীয় আনন্দ যা গোটা পরিবেশটাকেই উৎসবমুখর করে তুলেছে। আগের দিন আরাফায় অবস্থান করে রাতে মুজদালিফায় কাটিয়ে এখন যখন আমরা জামারায় চলে এসেছি, তখন কেমন যেন বিস্ময়ও জাগছিল মনে। আল্লাহতায়ালা আমাদের মতো গুনাহগারদের এতটা রহম করেছেন!

প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট হেঁটে জামারার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলাম। এটা পঞ্চমতলা ও ছাদ যার ওপর তাঁবুর মতো করে অস্থায়ী ছাউনি দেওয়া হয়েছে হাজিদের সুবিধার্থে। একটু এগোতেই দেখি দুপাশে অনেকেই বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন ও খাচ্ছেন। আমরাও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ছোট জামারা পার করে দক্ষিণ দিকে বসলাম। আমাদের পাশেই একটি পাকিস্তানি পরিবার বসে খাচ্ছিলেন। ভদ্রলোক সম্ভবত তাঁর মাকে নিয়ে এসেছেন যিনি হুইল চেয়ারে আসীন। তাঁরা আমাদেরও খাবার দিলেন--বিস্কুট, বাদাম ও খেজুর। ওদের সঙ্গে থাকা ফ্লাস্ক থেকে একটু পানিও পান করলাম।

আজ ১০ জিলহজ। হজের বড় দিন এবং ঈদুল আজহার দিন। হাজিদের এদিনের প্রথম কাজ হলো শুধু বড় জামারায় সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করা। আমরা বড় জামারার দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রচুর হাজির সমাগম। সবাই কঙ্কর মারছেন, কেউ মরিয়া হয়ে কেউ বা রয়েসয়ে। ভিড়ের কারণে অতীতে জামারায় দুর্ঘটনা ঘটতো, হাজিরা প্রাণ হারাতেন চাপা পড়ে। এখন জামারা পাঁচতলা ও যথেষ্ট প্রশস্ত করায় সেই সম্ভাবনা তিরোহিত। হঠাৎ দেখি যে বড় জামারার একটা দিক একেবারে ফাঁকা। আমরা দুজন দ্রুত পায়ে ওখানে গিয়ে দাঁড়ালাম একেবারে প্রাচীর ঘেঁষে। বড় জামারার চারপাশে কংক্রিটের চৌবাচ্চা যা কোমর সমান উচ্চতার এই প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ‘বিসমিল্লাহ‘ ও ‘আল্লাহু আকবর’ বলে রমি করা বা পাথর নিক্ষেপ শুরু করলাম। নিয়ম হলো প্রতিবার ‘আল্লাহু আকবর’ বলতে হবে এবং প্রতিটি পাথর জামারার বা মূল স্তম্ভের গায়ে লাগাতে হবে।

অবিশ্বাস্য দ্রুত সময়ে কঙ্কর নিক্ষেপ শেষ হয়ে গেল। আমরা সামনের দিকে যেতে থাকলাম। চিন্তা করছিলাম যে মিনায় তাঁবুতে ফিরে যাব না মক্কায় যাব। এতক্ষণ দলছুট থাকলেও কোনো চিন্তা হয়নি। এখন একটু চিন্তা হতে লাগল যে ঠিকঠাকমতো যেতে পারবতো?

জামারা থেকে বেড়িয়ে মক্কায় যাওয়ার অনেকগুলো পথ। আমরা একটা রাস্তার ধারে বসে পড়লাম। একজন ইন্দোনেশীয় মহিলা হাজি পানি ছিটাচ্ছিলেন। আমাদের চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিল হাসিমুখে। একপাশে আলবায়েক ও কেএফসির সামনে প্রচুর ভিড় দেখলাম। আমরা মক্কায় যাব ঠিক করে হাঁটা দিলাম। একজন বাংলাদেশি পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে জিজ্ঞাসা করায় সে ইশারায় রাস্তা দেখিয়ে বলল যে হাজিরা দলে দলে যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকে যেতে। কিন্তু রাস্তাতো কয়েকটা। শেষমেশ একটা ধরে হাঁটা দিলাম। পথে আরেকজন বাংলাদেশি কর্মীকে জিজ্ঞাসা করলাম যে বাস পাওয়া যাবে কোথায়। সে জানাল যে আজকে বাস পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে বিকেল বা সন্ধ্যা থেকে পাওয়া যেতে পারে। তাই হেঁটেই মক্কা যেতে হবে। অনেকে যাচ্ছেনও। একে বলে পায়ে দল সফর। আর পায়ে হাঁটার পথও আলাদা।

বেশ খানিকটা এগিয়ে বুঝলাম যে আমাদের মতো হাজার হাজার হাজি মক্কায় চলেছেন। অনেকেই পায়ে দল করে যাবেন। বাকিরা গাড়ি বা বাসের চেষ্টা করছেন। আমরা পার্কের মতো একটা সবুজ চত্বরে বসলাম। ওদিকে রাস্তায় গাড়ি ও মাইক্রোবাস কিছু মিলছে কিন্তু ওঠার কোনো সুযোগই নেই। দরদাম না করেই কেউ কেউ উঠে পড়ছে। চালকরাও এ সুযোগে দর চড়িয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎ চোখে পড়ল মোটরসাইকেলে চেপেও যাচ্ছেন কেউ কেউ। তবে সংখ্যা খুবই অল্প। আমি এক মোটরবাইক চালককে থামালাম। সে বলল হারামে যাবে, তবে ৩০০ রিয়েল দিতে হবে। বলে কী? আমি বললাম, ভাই তোমাকে ১০০ রিয়েল দেব। ও মাথা নেড়ে আপত্তি করছে দেখে বললাম, আরো ৫০ রিয়েল বকশিশ পাবে। অল্প বয়সী ছেলেটা সম্ভবত ইয়েমেনি। জলদি উঠতে বলল। ওর পেছনে আমি, আমার পেছনে আমার সহধর্মিণী। ছেলেটা প্রায় উড়িয়ে নিয়ে চলল আমাদের। যত বলি, আস্তে যাও, কে শোনে। টানেলের ভেতরে ঢোকার পর বিকট চিৎকার করে হেঁটে চলা হাজিদের হুঁশিয়ার করে ছুটে চলল। ১০ মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম হারাম প্রাঙ্গণের কাছাকাছি।

বাইক থেকে নেমে খানিকটা হেঁটে আমরা সাফা টাওয়ারের নিচে গিয়ে বসে পড়লাম হাত-পা ছড়িয়ে। ততক্ষণে পানিশূন্যতায় আমার দুই পায়ের পাতা বেঁকে গেছে। দুহাত দিয়ে টেনে টেনে পায়ের পাতা সোজা করার চেষ্টা করতে লাগলাম। বুঝলাম, পানি পান করতে হবে প্রচুর। যে দোকানটার সামনে বসেছিলাম, ওটার বাংলাদেশি কর্মী বলল যে এস্কেলেটর দিয়ে ওপরে গেলে ফুড কোর্ট। ওখান যে কোনো খাবার দোকান থেকে পানি কিনতে পারব। ছুটে গিয়ে চার বোতল পানি কিনে আনলাম। তারপর গলায় ঢালতে থাকলাম। এদিকে ক্লান্তিতে আমার সহধর্মিণী পিঠের ব্যাগকে বালিশ বানিয়ে একপাশে শুয়ে পড়েছে। আরও দুতিনজনকে দেখলাম একই অবস্থা।

মোটামুটি বিশ্রাম নিয়ে নিচ থেকে টয়লেট সেরে ও অজু করে আসলাম। জোহরের আজানের পর হারামের সঙ্গে মিলিয়ে ওখানেই মানে টাওয়ারের নিচতলায় জামাত দাঁড়িয়ে গেল। নামাজ পড়ে দুজনে ওপরে গেলাম খাওয়ার জন্য। দুটো চিকেন কেপসা নিলাম। তবে ভালোমতো খেতে পারলাম না। বাকিটুকু পার্সেল বানিয়ে বেড়িয়ে এলাম। ইব্রাহিম খলিল রোড ধরে গিয়ে উঠলাম হিজরা রোডে। তারপর হোটেলে নিজেদের কক্ষে।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন