মক্কায় প্রথম জুমা, হারামের গ্রন্থাগারে

আমরা মক্কায় পৌঁছে ওমরাহ করি শনিবার। এক সপ্তাহের মাথায় ৯ জুন মক্কায় মসজিদুল হারামে জুমার নামাজ আদায় করি। এটাই ছিল হজ সফরের প্রথম জুমা। কাবা শরিফের কাছাকাছি, অর্থাৎ মাতাফে এবং তার আশেপাশে মসজিদের ভেতরে একতলায় গিয়ে জুমা পড়তে হলে সকাল ১০টার মধ্যে যেতে হয়। আর ইহরামের লেবাস না থাকলে, অর্থাৎ ওমরাহ করতে যাওয়া ছাড়া কোনো পুরুষকে একতলায় ও মাতাফে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।

আমরা কয়েকজন সাড়ে ১০টার দিকে হারাম প্রাঙ্গণে এলাম। আমাদের ১১২-১১৩ নম্বর ফটক দিয়ে ঢুকিয়ে চারতলার ওপরে নতুন সম্প্রসারিত অংশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। নির্মাণকাজ পুরো শেষ না হওয়ায় এখানে তখনো শীতাতপ যন্ত্র বসেনি। অত গরমও অবশ্য লাগেনি। সালাত শেষে বাইরে আসতে আসতে বেশ সময় লেগে গেল স্বাভাবিকভাবেই। লাখ লাখ হজযাত্রীর সমাগম। আর প্রতিদিনই নানা দেশ থেকে হজযাত্রী আসছেন।

আরও পড়ুন

মক্কায় দ্বিতীয়দিনই আমরা দুজন দুটো সৌদি আরবের মোবাইল ফোনের সিম কিনে নিই। হিজরা রোডের ওপরই একটু পর পর একাধিক কোম্পানির বুথ থেকে বিভিন্ন প্যাকেজের সিম বিক্রি করা হয়। এসব সিমে শুধু সৌদি আরবের ভেতরে এবং বাংলাদেশে কথা বলা যায়।

আমার সহধর্মিণী আগে থেকেই খানিকটা অসুস্থ ছিল। বিশেষত শুষ্ক কাশি খুব ভোগাচ্ছিল। কোনো ওষুধেই কাজ দিচ্ছিল না। ফলে ওর সঙ্গে যে তিনজন একই কক্ষে থেকেছেন, তাঁদের যখন-তখন কাশির বিচ্ছিরি শব্দের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে নিয়মিত। তবু তাঁরা অনেক সবর করেছেন।

ওমরাহ করার পরের তিন-চার দিন আমার সহধর্মিণীর বুক ধড়ফড়ানি এত বেশি ছিল যে হোটেলকক্ষ থেকে হারামে যেতে পারেনি। আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে এরপর থেকে যাওয়া শুরু করেছে। এ সময় ওর বান্ধবী নাফিসার বোন রুবীও মক্কায় ছিল। ওদের হোটেল ছিল হারামের খুব কাছে, পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। একাধিক দিন জোহরের সালাতের পর রুবী আমার সহধর্মিণীকে ওদের হোটেল কক্ষে নিয়ে গিয়ে রেখেছে বিশ্রামের জন্য। রুবীর স্বামী সাইফুল করীম শায়ক ভাইর সঙ্গে তাদের হোটেলে বসে একাধিক সন্ধ্যায় মাগরিবের সালাতের পর খেজুর সহযোগে গাওয়াহ (আরবি কফি) পান করেছি, বিশ্রাম নিয়েছি।

আরও পড়ুন

মক্কায় তিনবেলা খাওয়াতে আমাদের বড় কোনো সমস্যা হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। আশে-পাশে প্রচুর খাবার দোকান এবং তা বাংলাদেশি ও পাকিস্তানিদের। তাছাড়া ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে বিভিন্ন ধরনের বনরুটি ও পাউরুটির সঙ্গে পনির, মেয়োনিজ, জ্যাম-জেলি কিনে হোটেল কক্ষে এনে নাশতা বানিয়ে খাওয়া যায়। আছে বিভিন্ন রকম ফলের জুস। হারাম প্রাঙ্গণের আশে-পাশে ক্লক টাওয়ার, সাফা টাওয়ার ও মক্কা টাওয়ারর নিচে কয়েকশ খাবারের দোকান ও রেস্তোরাঁ। চেইন সুপার শপ বিন-দাউদে কি না পাওয়া যায়। একটু বুঝে-শুনে চললে কম খরচে ভালো খাওয়া যায়।

হারাম এলাকাসহ পুরো মক্কা জুড়ে প্রচুর বাংলাদেশি আছেন। তাঁরা বিভিন্ন পেশায় ও বিভিন্ন কাজে জড়িত। তাঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু জানা যায় ও অনেক সহযোগিতা পাওয়া যায়। আমরা অনেকেই চেষ্টা করেছি হারামের কর্মীদের ও পথেঘাটের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের বিভিন্ন সময়ে সামান্য কিছু হাদিয়া দিতে।

মসজিদুল হারামের তৃতীয় তলায় রয়েছে একটি চমৎকার লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার। এখানে কয়েক দিন কিছু সময়ও কাটিয়েছি। আরবি, ফারসি, উর্দু, ইংরেজি, ফরাসি, ডাচ ও বাংলা ভাষার বিভিন্ন বই রয়েছে। সবচেয়ে বেশি স্বাভাবিকভাবেই আরবি ভাষায়। আছে উন্নতমানে কম্পিউটার যেখানে ই-বুক দেখা যায়, অডিও শোনা যায় হেডফোনে। তবে বেশির ভাগ সময়ই প্রবেশদ্বার নিয়ন্ত্রিত থাকে। তাই চাইলেই যে কোনো সময় ঢোকা যায় না। নির্ধারিত সময়সূচি থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা অনুসরণ না করে ওখানকার দায়িত্বরতদের মর্জিমতো পাঠকদের ঢুকতে দেওয়া হয়। ওয়েবসাইটেও কোনো কিছু ঠিকমতো দেওয়া নেই।

আরও পড়ুন

মদিনায় যাওয়ার আগে আমরা অনেকেই ব্যাংক থেকে দমে শোকর আদায়ের জন্য হজযাত্রী প্রতি ৭২০ রিয়াল দিয়ে কুপন কিনে ফেলি। মক্কা টাওয়ারের চতুর্থতলায় যেখানে আবু বকর মসজিদ তার পাশেই ব্যাংকের বুথ খোলা হয়েছিল। সাধারণভাবে যেটাকে হজের কোরবানি বলা হয়, সেটা হলো দমে শোকর বা হজ আদায়ের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ পশু জবাই। এটা ঈদুল আজহার পশু কোরবানি নয়, বরং হাদী বা হজের কোরবানি। সৌদি আরবের সরকারের তরফ থেকে পশু জবাই করার যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়। হাজিদের শুধু নির্ধারিত ব্যাংকের বুথ থেকে নির্ধারিত টাকা জমা দিয়ে কুপন কিনতে হয়। কেউ কেউ অবশ্য মিনায় গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে দমে শোকর আদায়ের জন্য পশু জবাই করেন। ওখানে কিছু বাংলাদেশি আছেন, যারা এই ব্যবস্থা করেন দেন। হজ কাফেলায় অনেক অভিজ্ঞ আলেম থাকেন, যাদের লোকজন আছে। তাঁদের মাধ্যমেও হাদী জবাই করেন কেউ কেউ। তবে একদম সুনিশ্চিত না হলে ব্যাংক থেকে কুপন নিয়ে নেওয়াই ভালো।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক।

আরও পড়ুন