ঈদুল আজহায় আরব দেশের বিচিত্র খাবার
ঈদুল আজহাকে আরব দেশগুলোতে অনেকে ‘বড় ঈদ’ বলে ডাকেন। কোরবানির আচার, পারিবারিক সমাবেশ এবং বিশেষ খাবারের মাধ্যমে ঈদুল আজহা আরব বিশ্বে একটি বর্ণিল উৎসবে রূপান্তরিত হয়।
আরব দেশগুলোতে ঈদ উৎসবের আচার-অনুষ্ঠান ও খাবার স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে অনন্য বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে।
ইতিহাসবিদ লিনা হামদান উল্লেখ করেছেন, ঈদের বর্তমান উদ্যাপন ইসলামি ঐতিহ্যের শতাব্দীপ্রাচীন ধারাবাহিকতা। ‘ঈদিয়া’, মিষ্টান্ন বিতরণ ও বিশেষ খাবার পরিবেশন ইসলামি যুগ থেকেই প্রচলিত। দশম শতকে ফাতেমিদের একটি উল্লেখযোগ্য প্রথা ছিল ঈদের দিনে ঈদিয়া বা ঈদ উপহার দেওয়া।
আরব দেশে আচার ও খাবার
আরব দেশগুলোতে ঈদুল আজহা ধর্মীয় আচার, পারিবারিক মিলন ও সাংস্কৃতিক প্রথার সমন্বয়ে পালিত হয়। কোরবানির মাংস দিয়ে তৈরি খাবার এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি দেশের নিজস্ব খাবার ও প্রথা রয়েছে, যা স্থানীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গেছে। নিচে আমরা কয়েকটি আরব দেশের আয়োজন ও খাবার সম্পর্কে তুলে ধরছি।
মিসর: টেবিলের রানি ‘ফাত্তা’
মিসরে ঈদুল আজহার একটি প্রচলন হলো রাস্তায় কোরবানি দেওয়া। ইবনে তাগরিবারদি (মৃ. ৮৭৪ হি.) মামলুক যুগের কায়রোর বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন, সেকালে কোরবানির সময় তাকবির ধ্বনি এবং রক্তের ধারা রাস্তায় প্রবাহিত করে একটি ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করা হতো। আজও মিসরীয়রা বাড়ির সামনে কোরবানি দেয়।
ঈদুল আজহায় মিসরের খাবারের টেবিলের রানি হলো ফাত্তা, যা কোরবানির মাংস, চাল, মসলাদার স্যুপ এবং টুকরা করা রুটি দিয়ে তৈরি করা হয়। তারপর খেজুর, রসুন ও সিরকা সহযোগে পরিবেশন করা হয়। লিনা হামদানের মতে, ফাত্তার উৎপত্তি ফারাওনিক যুগে, যখন এটি উৎসব ও আনন্দের সময় পরিবেশন করা হতো।
আরেকটি জনপ্রিয় খাবার হলো রাক্কাক নামের একধরনের পাতলা রুটি। উসমানিয়া যুগে উদ্ভূত এ খাবারটি মিসরীয়রা মাংস, পনির বা মসলা দিয়ে তৈরি করে। ঈদের প্রথম দিনের নাশতায় পরিবেশন করা হয় মসলা ও পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করা ‘কাব্দা ইস্কান্দারানি’ নামের আলেকজান্দ্রিয়ার স্টাইলে তৈরি ভুনা কলিজা।
ঈদের বর্তমান উদ্যাপন ইসলামি ঐতিহ্যের শতাব্দীপ্রাচীন ধারাবাহিকতা। ‘ঈদিয়া’ (ঈদ উপহার), মিষ্টান্ন বিতরণ ও বিশেষ খাবার পরিবেশন ইসলামি যুগ থেকেই প্রচলিত। দশম শতকে ফাতেমিদের একটি উল্লেখযোগ্য প্রথা ছিল ঈদের দিনে ঈদিয়া দেওয়া।লিনা হামদান, ইতিহাসবিদ
সিরিয়া: শাকরিয়ার ঐতিহ্য
সিরিয়ায় ঈদুল আজহা পারিবারিক মিলন ও বিশেষ খাবারের মাধ্যমে উদ্যাপিত হয়। সিরিয়ার প্রধান খাবার ডিশ হলো শাকরিয়া, যা কোরবানির মাংস, দই, মসলা ও নিস্তা (স্টার্চ) দিয়ে তৈরি। এটি চাল বা বুলগুর সহযোগে পরিবেশন করা হয়। হামদানের মতে, শাকরিয়া নামটি এসেছে একজন সিরিয়ান মায়ের কাছ থেকে, যিনি তাঁর ছেলে শাকরের জন্য এ খাবারটি তৈরি করতেন। এ খাবারটি শতাব্দী ধরে সিরিয়ান ঐতিহ্যের অংশ। গ্রীষ্মকালে ঈদ হলে দই দিয়ে তৈরি এ খাবারটি বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়।
আরেকটি খাবার হলো তাসকিয়া বা সিরিয়ান ফাত্তা, যা পরিবেশন করা হয় ঈদের সকালে। এটাও দইয়ের মিশ্রণে তৈরি, তবে সঙ্গে থাকে মাংস ও রুটি। ইবনে জাওজি (মৃ. ৫৯৭ হিজরি) উল্লেখ করেছেন, আব্বাসি যুগে দামেস্কে দরিদ্রদের মাঝে এ ধরনের খাবার বিতরণ করা হতো।
লেবানন: তাব্বুলার বৈচিত্র্য
লেবাননের দস্তরখানে থাকে মালুখিয়া এবং ভাতের সঙ্গে মাংস। মালুখিয়া হলো জুটপাতার তরকারি। তবে তাব্বুলা ঈদের খাবারের অপরিহার্য অংশ। তাব্বুলা একটি সতেজ, হালকা ও স্বাস্থ্যকর খাবার, যা প্রধানত পার্সলে, টমেটো ও বুলগুর (ভাঙা গম) দিয়ে তৈরি করা হয়।
মাকরিজি (মৃ. ৮৪৫ হি.) ফাতেমি যুগে লেবাননের উৎসবের বর্ণনায় সালাদ ও মাংসের সমন্বয় উল্লেখ করেছেন। লেবাননের পরিবারগুলো ঈদে সবাই জমায়েত হয়ে একসঙ্গে ঐতিহ্যবাহী খাবার ভাগ করে খায়। হামদানের মতে, এটা লেবাননের প্রথা শতাব্দীপ্রাচীন ইসলামি ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা। তারা মনে করে, খাবার ভাগাভাগি সম্প্রদায়ের ঐক্যকে শক্তিশালী করে।
‘শাকরিয়া’ নাম এসেছে একজন সিরিয়ান মায়ের কাছ থেকে, যিনি তাঁর ছেলে শাকরের জন্য এ খাবারটি তৈরি করতেন। এ খাবারটি শতাব্দী ধরে সিরিয়ান ঐতিহ্যের অংশ।
জর্ডান: মানসাফ ও ঈদিয়া
জর্ডানে ঈদুল আজহার প্রধান খাবার হলো মানসাফ, যা কোরবানির মাংস, চাল ও জামিদ (শুকনা দই) দিয়ে তৈরি। একে বলে জর্ডানের জাতীয় খাবার এবং ঈদের খাবারের মূল মেনু।
হামদান উল্লেখ করেছেন, মানসাফের পুষ্টিগুণ এবং সাংস্কৃতিক মর্যাদাই এই খাবারকে ঈদের জন্য আদর্শ করে তুলেছে। আরেকটি জনপ্রিয় খাবার হলো মাকলুবা, যা মাংস, চাল ও শাকসবজি দিয়ে তৈরি।
জর্ডানে ঈদিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথা। শিশুদের আনন্দ দিতে এবং নারীদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে নগদ অর্থ বা উপহার দেওয়া হয়। ইবনে বতুতা (মৃ. ৭৭৯ হি.) তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে উল্লেখ করেছেন, মধ্যযুগে জর্ডানে ঈদের সময় উপহার বিনিময় প্রচলিত ছিল।
ইরাক: দোলমা ও মাসগুফ
ইরাকে ঈদের খাবার টেবিলে দোলমা অপরিহার্য। দোলমা তৈরি হয় শাকসবজি (যেমন পেঁয়াজ, টমেটো), মাংস, চাল ও মসলা দিয়ে। আরেকটি বিখ্যাত খাবার হলো ছ মসলা দিয়ে গ্রিল করে তৈরি ‘মাসগুফ’। হামদানের মতে, মাসগুফ ইরাকের নদীভিত্তিক সংস্কৃতির প্রতীক। ইবনে জাওজি আব্বাসি বাগদাদে মাছ ও মাংসের সমন্বয়ে তৈরি খাবারের উল্লেখ করেছেন, যা দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হতো।
মরক্কো: বোলফাফ ও ওসবান
মরক্কোতে ঈদুল আজহার একটি বিশেষ খাবার হলো কোরবানির দুম্বার কলিজা দিয়ে তৈরি ‘বোলফাফ’। কলিজাটি প্রথমে কয়লার আগুনে ভেজে মসলা দিয়ে মুড়িয়ে দুম্বার চর্বিতে মুড়ে আবার ভাজা হয়। আরেকটি জনপ্রিয় খাবার হলো ওসবান, যা দুম্বা, গরু বা উটের ভুঁড়ির মধ্যে আলু, বেগুন, কুসকুস বা মাথার মাংস দিয়ে তৈরি। হামদান উল্লেখ করেছেন, ওসবান মাগরিব অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার।
কাবসা: উপসাগরীয় দেশগুলোর ঐতিহ্যবাহী খাবার
উপসাগরীয় দেশগুলোতে (সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত) কাবসা ঈদের দস্তরের প্রধান খাবার। এটি মাংস, চাল এবং জাফরান ও দারুচিনির মতো মসলা দিয়ে তৈরি। হামদানের মতে, কাবসা উপসাগরীয় সংস্কৃতির প্রতীক। আরেকটি খাবার হলো কলিজা ও প্লীহা গ্রিল করে তৈরি মাকলাই।
কাতারে ঈদের খাবার টেবিলে হারিস (গম ও মাংসের পোরিজ), মাজবুস (মসলাদার চাল ও মাংস) এবং সারিদ (রুটি ও মাংসের স্যুপ) জনপ্রিয়। এ ছাড়া উপসাগরীয় পরিবারগুলো ঈদের দিনে মাংস, চাল ও সুগন্ধি মসলা দিয়ে তৈরি বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করে। ইবনে বতুতা উপসাগরীয় অঞ্চলে উৎসবের দিনগুলোতে এ ধরনের মসলাদার খাবারের কথা উল্লেখ করেছেন।
ঈদুল আজহা আরব বিশ্বে ধর্মীয় তাৎপর্য, সামাজিক ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের একটি উৎসব তো বটেই, সেই সঙ্গে খাবারের ঐতিহ্যও তাদের আনন্দের উপাদান হিসেবে কাজ করে। মিসরের ফাত্তা, সিরিয়ার শাকরিয়া, জর্ডানের মানসাফ এবং উপসাগরীয় কাবসার মতো খাবারগুলো নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্য ও স্বাদের প্রতিনিধিত্ব করে। কোরবানির মাংস বিতরণ, পারিবারিক সমাবেশ ও ঈদিয়ার মতো প্রথাগুলো শতাব্দীপ্রাচীন ইসলামি মূল্যবোধের প্রতিফলন।
সূত্র: আল–জাজিরা ডট নেট