হজরত উমর (রা.) হিজরি সন প্রবর্তন করেন
হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তাঁর খিলাফতের সময় উল্লেখযোগ্য কিছু অবদান রাখেন। সেগুলোর মধ্যে আছে হিজরি সন প্রবর্তন, তারাবিহর নামাজ জামাতে পড়ার ব্যবস্থা, নাগরিকদের তালিকা প্রণয়ন, বিচারের জন্য কাজি নিয়োগ, ডাকব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাতি। তিনি বহু রাজ্য জয় করে সামাজ্য বিস্তার করেন, নগর পত্তন করেন, এবং রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করেন। উমর (রা.) প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্রমে সাহাবিদের বেতন নির্ধারণ করেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা ও প্রসারের ক্ষেত্রেরো উমর (রা.)–এর অবদান প্রচুর। তিনি আরবি কবিতা পাঠ এবং তা সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেন। আরবি ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার ব্যাপারে তিনি খুব সচেতন ছিলেন।
উমর (রা.) জন্মগ্রহণ করেন ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে, মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে।
যৌবনের শুরুতে তিনি অভিজাত আরবদের মতো যুদ্ধবিদ্যা, কুস্তি, বক্তৃতা, বংশতালিকা ইত্যাদি সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান কুস্তিগির। আরবের উকাজ মেলায় তিনি কুস্তি লড়তেন। সে সময়ে শ্রেষ্ঠ কবিদের প্রায় সব কবিতা তাঁর মুখস্থ ছিল। উমর (রা.) ব্যবসা করতেন।
আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেছেন যে উমর (রা.) কাঁধে তলোয়ার ঝুলিয়ে রাসুল (সা.)-কে হত্যার উদ্দেশে যাচ্ছিলেন। পথে এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা। সে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ, উমর? তিনি বললেন, মুহাম্মদের দফারফা করতে। লোকটি বলল, একটি কথা শোনো, তোমার বোন ফাতিমা আর তার স্বামী সাঈদ তোমার ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছে। এ কথা শুনে রাগে উন্মত্ত হয়ে উমর ছুটে গেলেন বোনের বাড়িতে।
ফাতিমা আর তাঁর স্বামী তখন পবিত্র কোরআনের সুরা ত্বহা পড়ছিলেন। উমরের পায়ের শব্দ পাওয়ামাত্র তাঁরা চুপ হয়ে গেলেন। কোরআনের পাতা লুকিয়ে ফেললেন। উমর (রা.) ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী পড়ছিলে? বোন নিরুত্তর। উমর (রা.) বললেন, আমি জেনে ফেলেছি যে তোমরা দুজনই ধর্মত্যাগী হয়েছ। এই বলে উমর (রা.) ভগ্নিপতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বোন স্বামীকে রক্ষা করতে এলে তিনি তাঁকেও আঘাত করলেন। বোনের দেহ রক্তাক্ত, ভগ্নিপতিরও! বিক্ষত দেহ, রক্তাক্ত পোশাক আর চোখভরা কান্না নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে ফাতিমা বললেন, উমর, যা ইচ্ছা করতে পারো। আমাদের পক্ষে ইসলাম ত্যাগ করা কখনো সম্ভব নয়!
(উমর বললেন,) তোমরা যা পড়ছিলে, সেটা আমাকে একটু পড়তে দাও তো! তাঁর বোন বললেন, পবিত্র হয়ে এসো। পবিত্র হয়ে এসে তিনি বোনের হাত থেকে সুরা ত্বহার অংশটুকু নিয়ে পড়তে শুরু করলেন।
(এর পর) সেই তলোয়ার হাতে উমর ছুটলেন রাসুল (সা.)–এর কাছে। রাসুল (সা.) দারুল আরকামে অবস্থান করছিলেন। তাঁর ওপর তখন ওহি নাজিল হচ্ছিল। রাসুল (সা.)–এর পায়ের কাছে তলোয়ার ফেলে উমর (রা.) বলে উঠলেন, কোনো সন্দেহ নেই, আপনিই আল্লাহর রাসুল! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনিই আল্লাহর রাসুল!
মদিনায় হিজরতের পর সব যুদ্ধ, চুক্তি, বিধিবিধান প্রবর্তন, ইসলাম প্রচারের বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন—সব ঘটনায় রাসুল (সা.)–এর সঙ্গে উমর (রা.) সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
খাইবারের বিজিত ভূমি মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টনের সময় হজরত উমর (রা.) তাঁর ভাগটুকু আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দেন। তাবুক অভিযানের সময় রাসুল (সা.)–এর আবেদনে সাড়া দিয়ে তিনি তাঁর অর্ধেক সম্পদ রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর হাতে তুলে দেন।
আবু লুলু ফিরোজ নামে এক অগ্নি–উপাসক দাস ফজরের নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় হজরত উমর (রা.)–কে ছুরির আঘাত করে। আহত উমর (রা.) শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। প্রায়ই তাঁর ক্ষত থেকে প্রচুর রক্ত বের হতো। আহত হওয়ার তৃতীয় দিনে হিজরি ২৩ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। মদিনায় মসজিদে নববিতে হজরত আবু বকর (রা.)–এর কবরের পাশে হজরত উমর (রা.)–এর কবর।